সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে দুর্ভোগ

খাদ্য-পানি-ওষুধ সংকটে বানভাসিরা হ নদীর পেটে যাচ্ছে সড়ক, বাঁধ, বসতভিটা, আবাদি জমি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যার পানি কমলেও বাড়ছে দুর্ভোগ

কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। তবে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি, উল্টো নদী ভাঙন তীব্র হওয়ায় বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমি, সড়ক, বাঁধসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ছবিটি গতকাল সিরাজগঞ্জ থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অবিরাম বৃষ্টি ও উজানের ঢলে তিন মাসের মধ্যে পঞ্চম দফা বন্যা মোকাবিলা করছে দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্য ও মধ্যাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। গত দুই দিন ধরে কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। তবে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ কমেনি, উল্টো নদী ভাঙন তীব্র হওয়ায় বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমি, সড়ক, বাঁধসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সেই সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও গোখাদ্যের চরম সংকট। পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের গতকাল সকালের তথ্যানুযায়ী, কুশিয়ারা ছাড়া দেশের সব নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামীকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। দেশের উত্তর, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে পানি কমলেও গতকাল সকালে সাতটি নদীর পানি ৯টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আজ তিন-চারটি নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নামতে পারে বলে সংস্থাটির পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে।

বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে শত শত হেক্টর জমির ফসল। চোখের সামনে পচে নষ্ট হচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। সেই সঙ্গে নদী ভাঙনে প্রতিদিন নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য পরিবার। এখনো পানিবন্দী বিভিন্ন জেলার কয়েক লাখ মানুষ। গতকাল দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার বুলাকিপুর ইউনিয়নের করতোয়া নদীর তীরবর্তী জয়রামপুর, কৃষ্ণরামপুর, পার কৃষ্ণরামপুর ও সোনার পাড়া চর এলাকার শতাধিক পানিবন্দী মানুষের মাঝে আয়েশা (রা.) সালাফিয়া বালিকা মাদ্রাসার উদ্যোগে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয় বলে জানিয়েছেন আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো আরও খবর-

সিরাজগঞ্জ : শুকনো খাবার-পানিবাহিত রোগের ওষুধ ও গোখাদ্যের সংকটে ভুগছে সিরাজগঞ্জের বন্যা কবলিতরা। প্রথম দফা বন্যায় কিছু সহায়তা মিললেও দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম দফা বন্যায় কোনো সহায়তা পায়নি হতভাগা মানুষগুলো। অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর দিন পার করছেন তারা। পঞ্চম দফা বন্যায় নতুন করে কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার চর ও নিম্নাঞ্চলের ৩ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমির রোপা আমন, ৯৩১ হেক্টর জমির মাষকলাই, ২৩৪ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি, ৮০ হেক্টর জমির বাদাম ও ৬৮ হেক্টর জমির মরিচ পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পানিতে তলিয়ে থাকায় তাঁত কারখানাগুলো বন্ধ রয়েছে। হাতে অর্থ না থাকায় অনেক পরিবারের বাজারঘাট বন্ধ। সার্বক্ষণিক পানিতে থাকায় হাত-পায়ে ঘাসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে অনেক মানুষের, মিলছে না চিকিৎসা ও ওষুধ। এ ছাড়া ভাঙনের কারণে প্রতিদিন ফসলি জমি হারিয়ে এক সময়ের সম্পদশালী পরিবারগুলো মুহূর্তে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। ভাঙনকবলিত চৌহালীর বাসিন্দা আফজাল জানান, পৈতৃক ভিটা নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? বারবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা আশ্বাস দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

মেহেরপুর : জেলার মুজিবনগর উপজেলায় দুটি গ্রামের দুই হাজার বিঘা জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে আরও হাজার বিঘার সবজি  খেত। স্থানীয়রা জানান, মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর ও গৌরীনগর গ্রামে জনদুর্ভোগের এ চিত্র প্রতি বছর ঘটছে। কৃষক ওমর উদিন জানান, মুজিবনগর উপজেলার নাগা বিল সংলগ্ন সুচোখোলা মাঠের উঠতি ফসল পানিতে ডুবে আছে এক মাসের বেশি। এতে প্রায় কোটি কোটি টাকার ফসল ক্ষতির মুখে পড়েছে। স্বাধীনতা-পূর্ব ওই মাঠের পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি খাল ভৈরব নদের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন জমির মালিক তাদের জমিতে পুকুর খনন ও ইটভাটা নির্মাণের কারণে পানি নিষ্কাশন পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে মাঠের পানি ভৈরব নদে নামতে পারছে না। লালমনিরহাট : আবারও তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচায় অবস্থিত তিস্তা নদীর বামতীরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সলেডি স্প্যার-২। নির্ঘুম রাত কাটছে বাঁধের ভাটিতে থাকা কয়েক হাজার পরিবারের। শনিবার রাত থেকে তৃতীয় দফায় ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়ে বাঁধটি। গতকাল বিকাল নাগাদ বাঁধের প্রায় ৯০ মিটার এলাকার এক-তৃতীয়াংশ বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানান, তিস্তা নদীর বামতীরের ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষায় ২০০৩-৪ সালে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন এলাকায় সলেডি স্প্যার বাঁধ-২ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত বছর কিছু অংশে ভাঙন দেখা দিলে তা সংস্কার শুরু করে। সংস্কার কাজ শেষ হতে না হতেই গত ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে তিস্তায় পানি কমে যাওয়ায় আবার ভাঙনের কবলে পড়ে বাঁধটি।

বগুড়া : বাঙ্গালী নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে সোনাতলার হাটকরমজা-গণকপাড়া পাকা সড়কটি। এরই মধ্যে সড়কের অনেকটা অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সড়কটি নদীগর্ভে গেলে সোনাতলার সঙ্গে সারিয়াকান্দি উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়েছে গণকপাড়া বাজার, গণকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গণকপাড়া কলেজ ও গণকপাড়া উচ্চবিদ্যালয়সহ ১০টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার বসতবাড়ি। গত ৩/৪ বছর ধরে সোনাতলা উপজেলার ১৯টি পয়েন্টে বাঙ্গালী নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে শত শত বিঘা আবাদি জমি, ঘরবাড়ি, গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন তীব্র হয়েছে যমুনা নদীতেও। স্থানীয়রা জানান, বাঙ্গালী নদী থেকে গণকপাড়া বাজার ও তিনটি প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব এখন মাত্র ৩০০ গজ। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধ করা না গেলে অল্প সময়ের মধ্যেই স্থাপনাগুলো মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর