বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কৃষিতে অবদান রাখতে পারে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা

প্রয়োজন কৃষি নীতিমালায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা

নিজামুল হক বিপুল

মো. ইবরাহিম খলিল একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। পেশায় কৃষক। প্রতিবন্ধী হলেও নিজেকে একমুহূর্ত ঘরে আটকে রাখতে পারেন না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির পাশে নিজের কৃষিজমিতে নানা রকম সবজি চাষের কাজে ব্যস্ত থাকেন। শারীরিক সমস্যার কারণে দূরের বাজারে যেতে না পারলেও উৎপাদিত সবজি দিয়ে নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে গ্রামের বিভিন্ন লোকের কাছে বিক্রি করেন। এ আয় থেকে চলে তার তিন সদস্যের সংসার। রাজধানীর অদূরে ধামরাই উপজেলার সূতিপাড়া গ্রামের খলিলের মতো এ গ্রামে আরও অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী আছেন যারা কৃষিকাজ করেই সংসার চালান। যদিও কৃষিকাজে তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কারণ তারা কৃষির আধুনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে যেমন এখনো পরিচিত হতে পারেননি, তেমনি তাদের জন্য কৃষি বিভাগ থেকে নেই কোনো সহযোগিতা। সরকারের কৃষি নীতিমালায়ও দেশের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতার  বিষয়ে কৃষি নীতিমালায় সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলে একদিকে যেমন শারীরিক প্রতিবন্ধীরা পরিবারের বোঝা না হয়ে স্বাবলম্বী হবেন, তেমনি কৃষি খাতে তাদের কনট্রিবিউশনও থাকবে। এ জন্য সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কৃষি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্র্রতিবন্ধী ও তাদের পরিবারের কৃষি ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, কৃষিনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাদের প্রশিক্ষণের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতিবন্ধী ও নারী উপযোগী কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়নে দিতে হবে আরও গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার।

সরকারের সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২১ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৬। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী ১০ লাখ ১ হাজার ২৯৬ জন। প্রতিবন্ধীদের এ সংখ্যা প্রতিদিন আপডেট হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের একটি উইং প্রতিবন্ধীদের তথ্য সংগ্রহে নিয়মিত কাজ করছে। জানা গেছে, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের একটা বড় অংশই পরিবারের বোঝা না হয়ে নিজেরা বিভিন্ন কাজকর্ম করছে। বিশেষ করে বাড়ির পাশে নিজের জমিতে ধান চাষ থেকে শুরু করে নানা রকম সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন এবং মাছ চাষ করছে। কেউ কেউ করছে অন্য কাজ।

সম্প্রতি সরেজমিন ধামরাইয়ের সূতিপাড়ায় গিয়ে বেশ কয়েকজন শারীরিক প্রতিবন্ধীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউই পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে চান না। তাই নিজেরা যেসব কাজ করতে সক্ষম, সে রকম কাজ করে পরিবারের আয়ে সহযোগিতা করছেন। সূতিপাড়ার ইবরাহিম খলিল তো নিজে আয় করেই পরিবার চালান। ইবরাহিম বাংলাদেশ প্রতিদনকে বলেন, ‘আমি প্রতিবন্ধী বলে কৃষিকাজে সরকারের কোনো সাহায্য পাই না। সার, বীজ থেকে শুরু করে সবই নিজের টাকায় সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় ধারদেনা করে সবকিছু জোগাড়-যন্ত্র করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘সরকার যদি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা কাজ করতে পারেন তাদের আর্থিক সাহায্য করত, কৃষিঋণ দিত, বিনামূল্যে সার-বীজ দিত তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।’ একই এলাকার ৩৫ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরুজ মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার সংসার চলে কৃষিকাজ করে। বীজতলা লাগানো থেকে শুরু করে চারা রোপণ, জমির আগাছা পরিষ্কার করা- সব কাজই তিনি নিজে করেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় কাজ করতে অনেক সময় কষ্ট হয়। কিন্তু হাল ছাড়েন না। সুরুজ মিয়া বলেন, ‘সংসার চালাতে হলে কাজ না করে উপায় নেই। সরকার কৃষকদের যেভাবে নানা সাহায্য-সহযোগিতা করে, একইভাবে যদি আমাকে বা আমার মতো যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদের কৃষিঋণ দেওয়া থেকে শুরু করে অন্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করত, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।’

শারীরিক প্রতিবন্ধীরা কৃষিকাজ করলেও তাদের জন্য সরকারের জাতীয় কৃষি নীতিমালায় কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শারীরিক প্রতিবন্ধীরা দেশের কৃষি খাতে অনেক ভূমিকা রাখতে পারত। বিশেষ করে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পেলে নিজেদের বাড়ির পাশেই নানা রকম খামার করে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারত তারা।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও কৃষি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘২০১৮ সালের জাতীয় কৃষি নীতিমালায় প্রতিবন্ধীদের কথা এক লাইনে উল্লেখ আছে। প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতার জন্য তা মোটেই যথেষ্ট নয়।’ তিনি বলেন, ‘সরকার যে ৯ শতাংশ কৃষিঋণ দেয় তা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা যেন ব্যাংক থেকে সহজেই কোনো রকম হয়রানি ছাড়া ঋণ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিকাজের পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন এবং মাছ চাষে অগ্রাধিকার দিতে হবে তাদের। মাঠপর্যায়ে কৃষি বিভাগের যেসব কর্মী রয়েছেন তারা যেন এসব শারীরিক প্রতিবন্ধীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সহযোগিতা করেন তা নিশ্চিত করতে হবে।’

আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা যেসব পণ্য উৎপাদন করবে সেগুলো বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের কৃষি বিপণন বিভাগ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য সুস্পষ্টভাবে কৃষি নীতিমালায় নির্দেশনা থাকতে হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবন্ধীদের আধুনিক কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাব দূর করতে হবে। ফসলের রোগবালাই সম্পর্কে ধারণা ও রোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম তথ্য প্রদান ও পরামর্শের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি ও করণীয় সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে ক্ষতিপূরণের। কৃষিকাজে দিতে হবে প্রশিক্ষণ, সরবরাহ করতে হবে প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত যন্ত্রপাতি। সহজ শর্তে কৃষিঋণ, অনুদান ও প্রাপ্তির তথ্য জানানোর পাশাপাশি এগুলোর প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

উৎপাদিত পণ্যের সংরক্ষণ, মজুদ, বাজারের চাহিদা, বিপণন সম্পর্কে প্রতিবন্ধীদের জানার অভাব রয়েছে তা দূর করতে হবে। বাজারজাতের ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াতে পারে। এতে তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে। সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য থাকবে না।

এর বাইরে প্রতিবন্ধীদের কৃষিঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দালালের দৌরাত্ম্য যেন না থাকে এবং পরিশোধের ক্ষেত্রে যেন চাপ প্রয়োগ না করা হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে।

‘এমপাওয়ার এসএইচজি অন কনভেইনিং অ্যান্ড কনভেইসিং (ইএসসিসি) প্রকল্প’-এর আওতায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে দি লেপ্রোসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মাছুমা পারভীন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি। দেখতে পাচ্ছি শারীরিক প্রতিবন্ধীরা কৃষি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারছে। কিন্তু তাদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তা তারা কাজে লাগাতে পারছে না সুযোগ-সুবিধার অভাবে। সরকারের জাতীয় কৃষি নীতিমালায় যদি তাদের সব ধরনের সহযোগিতার বিষয়ে নির্দিষ্ট করে নির্দেশনা থাকত তাহলে তারা ভালো করতে পারত।’

কৃষি নীতিমালায় প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো নির্দেশনা যুক্ত হবে কি না- জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অবশ্যই। আমাদের কৃষি নীতিমালায় প্রতিবন্ধীদের জন্য ওইভাবে তেমন কিছু নেই। এটা থাকা উচিত। প্রতিবন্ধীরা সমাজেরই অংশ। তাদেরও কাজ করার সুযোগ আছে।’ কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রতিবন্ধীদের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করব, যাতে তারা সহজেই কৃষির সুযোগ-সুবিধা পায়।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, তাঁর মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো কিছু নেই। তবে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে যদি কোনো রকম প্রকল্প নেওয়া হয়, সেখানে তাঁর মন্ত্রণালয় ভূমিকা রাখতে পারবে।

সর্বশেষ খবর