শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ধ্বংসের মুখে চিনিশিল্প

কলে মাড়াই বন্ধ, মানবেতর জীবনে আখ চাষিরা

প্রতিদিন ডেস্ক

ধ্বংসের মুখে চিনিশিল্প

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) লোকসানের বোঝা কমানোর অজুহাতে সরকারি ছয় চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে এসব চিনিকলে চলতি অর্থবছরের আখ মাড়াই। এ জন্য চরম বিপাকে পড়েছেন আখচাষিরা। শুধু তাই-ই নয়, তারা মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। ওয়াকিবহালদের আশঙ্কা, এভাবে আখচাষিদের নেতিবাচক অবস্থানে ঠেলে দিলে দেশের চিনিশিল্পই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সূত্র বলছে, লোকসানের অজুহাতে কলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলেও এই লোকসানের পেছনে যে দায়িত্বশীলদের সীমাহীন দুর্নীতি কাজ করেছে, সে বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে মূল অপরাধীদের সাজা না হলেও খেসারত দিতে হচ্ছে উৎপাদক আখচাষিদের। তাদের দুরবস্থা নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- পাবনা :  বন্ধ ঘোষণায় চিনিকল এলাকার কৃষকরা আবাদ করা খেতের আখ নিয়ে হতাশ। পাবনা চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর অত্র এলাকার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। আর উৎপাদন হয়েছে ৭২ হাজার মেট্রিক টন আখ। আখ কেটে চিনিকলে সরবরাহ করে যে সময় কৃষকরা অর্থ উপার্জন করবে, ঠিক তার পূর্ব মুহূর্তে পাবনা চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করায় কৃষকদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। গত ২ ডিসেম্বর পাবনা চিনিকলে এ নির্দেশনা আসার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পাবনা চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিদের মাঝে। ফরিদপুর : ফরিদপুর সুগার মিলে বর্তমানে ৪ হাজার ২০০ চুক্তিবদ্ধ আখচাষি রয়েছেন। বর্তমানে মিল কর্তৃপক্ষের কাছে আখচাষিদের পাওনা রয়েছে কয়েক কোটি টাকা। তাছাড়া আখচাষি কল্যাণ সংস্থা মিল কর্তৃপক্ষের কাছে ২১ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা : একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ব চিনিকল বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তে সারা দেশের চিনিকল শ্রমিকদের মতোই শঙ্কিত চুয়াডাঙ্গার কেরু চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা। কেরুর ডিস্ট্রিলারি বিভাগের সাফল্যে বর্তমানে এ মিলটি বন্ধ করার পরিকল্পনা না থাকলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা চিন্তিত এর শ্রমিক-কর্মচারীরা। ঝিনাইদহ : পাওনার দাবিতে ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল আখচাষিরা বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। এদিকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চাষিদের অনেকেই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। জয়পুরহাট : ৫৮ বছর পার করা দেশের সর্ববৃহৎ জয়পুরহাট চিনিকলের স্থান এখন রুগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের তালিকায়। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে চিনিকলটি কোনোরকম উৎপাদন প্রক্রিয়া ধরে রাখলেও শ্রমিক কর্মচারীতের শঙ্কা যে কোনো সময় এই চিনিকলটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পঞ্চগড় : পঞ্চগড় সুগার মিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আখচাষি এবং শ্রমিক কর্মচারীরা মিলটি চালু করার দাবিতে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে আখচাষিদের। তারা বলেন, নভেম্বর থেকে আখ মাড়াই শুরু হওয়ার কথা। গাইবান্ধা : রংপুর সুগার মিল সূত্রে জানা গেছে, এই মিলের আওতায় গাইবান্ধা, বগুড়া ও রংপুর জেলার পাঁচ হাজার ৪১৮ জন আখচাষি আছেন। এদের তদারকি চাষি হিসাবে মিল কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করেন।

রংপুর আখচাষি কল্যাণ গ্রুপের সভাপতি জিন্নাত আলী প্রধান বলেন, এক বছর আখ রোপণ করলে তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বর্তমানে জমিতে যে আখ আছে তা পাশর্^বর্তী জেলা জয়পুরহাটের সুগার মিলে সরবরাহ করার কথা জানিয়েছে রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হওয়ার কারণে মাঠের আখ শুকিয়ে ওজন কমে চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাই ‘রংপুর সুগার মিল’ চালু রাখার দাবিতে আমরা আন্দোল করছি।

এদিকে জমিতে দন্ডায়মান ৫৫ হাজার মেট্রিক টন আখ নিয়ে চাষিরা এখন শঙ্কায় আছেন। হতাশাগ্রস্ত হয়ে মহিমাগঞ্জের এক আখ চাষি তার জমির আখে আগুন পর্যন্ত দিয়ে বসেছেন। গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে রংপুর সুগার মিল চত্বরে আখ ক্রয়ের সিদ্ধান্ত ছিল কিন্তু এখনো তা শুরু হয়নি। প্রতি মণ আখ ১৪০ টাকা দরে মিলের ক্রয় করার কথা। কিন্তু এই মূল্যে চাষিদের তেমন কোনো লাভ থাকে না বলে তাদের অভিযোগ।

মহিমাগঞ্জের আখচাষিরা জানান, মিল যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে তারা মহা বিপদে পড়বেন। ১৯৫৬ সাল থেকে তারা বংশানুক্রমিকভাবে আখ চাষ করায় অন্য কোনো চাষে তাদের দক্ষতা নেই। আবার বর্তমান বছর অন্য মিলের জন্য আখ কেনার কথা বললেও পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়া সরকার চালু রাখবে না বলে তারা সন্দেহ করছেন। তাই রংপুর সুগার মিল চালু রাখার দাবি জানান তারা।

নাটোর : নাটোরে দুটি চিনিকল থাকা সত্ত্বেও লাভজনক অর্থকরী ফসল আখ চাষের আবাদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আখচাষিরা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এখানকার মাটি ও আবহাওয়া আখ চাষের অনুকূল হলেও শুধু কৃষি ঋণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখানকার চাষিরা আখ চাষে আগের মতো উৎসাহ পাচ্ছেন না। চিনি শিল্পের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আখেরও দুর্দিন শুরু হয়েছে। গত সাত বছর দেশে নতুন জাতের কোনো আখ চাষ হয়নি। চাষিরা পুরনো জাতের আখ প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষ করে আসছেন। ফলে আখের ফলন বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে।

একই গ্রামের আখচাষি ইসমাইল, মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, তারা ১৫ বছর ধরে আখ চাষ করছেন। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে তারা এ পেশা ধরে রেখেছেন। প্রতি বছর আখ জমি থেকে কাটার পর পরই মিল কর্তৃপক্ষ নতুন আখ রোপণ করার জন্য সার কীটনাশক প্রদান করে। এখন সে সবের কিছুই দেয়নি চাষিদের। এ ছাড়া চলতি মৌসুমের দুই সপ্তাহ কেটে গেলেই সরবরাহকৃত আখের মূল্য পরিশোধ করেনি দুটি মিল কর্তৃপক্ষ। ফলে আখচাষিরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

কুষ্টিয়া : আখচাষি ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের আবেদন-নিবেদন, আন্দোলন সব কিছু উপেক্ষা করে ৫৯ বছর পর বন্ধ হয়ে গেছে কুষ্টিয়ার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া সুগার মিল। এতে মিলের সহশ্রাধিক শ্রমিক-কর্মচারী আর ১৫ হাজার আখচাষি মহাসংকটে পড়েছেন।

কুষ্টিয়া সুগার মিলস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি ফারুক হোসেন চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জোর দাবি জানান। শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান বলেন, দেশে চিনিকল চালু আছে তাই আজও চিনির বাজার সহনশীল। চিনিকল বন্ধ করে চিনির বাজারকে অসহনশীল করার চেষ্টা করছে একটি মহল। তার মতে, কোনো মহলের বাজার তৈরি করে দেওয়ার জন্যই এমন ষড়যন্ত্র চলতে পারে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর