সোমবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন নিয়ে সারা দেশে সংকট

ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

নিজামুল হক বিপুল

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিয়াদ মল্লিক। তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মসনদ নিতে গত মাসে গিয়েছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে। কিন্তু কাউন্সিলর তাকে জানিয়ে দেন, এ মুহূর্তে সনদ দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি। শুধু রিয়াদ মল্লিক নন, সারা দেশে এ রকম বহু লোক এ বছর নিজের শিশুসন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে রীতিমতো নাকানিচুবানি খেয়েছেন। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কেউ কেউ হয়তো বিদ্যালয়প্রধানকে বুঝিয়ে সময় নিয়েছেন জন্মসনদ দেওয়ার। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি অভিভাবকরা। একইভাবে চাকরির আবেদন ও জরুরি পাসপোর্ট করতে গিয়েও জন্মসনদ দিতে পারছেন না হাজার হাজার মানুষ। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার দফতরের সার্ভার জটিলতায় সারা দেশে জন্ম ও মৃত্যুর সনদ পেতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জন্মসনদ নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়মকানুন। বিশেষ করে জন্মসনদে দ্বৈততা পরিহার করতে সরকার জন্মসনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু তথ্য সংযুক্ত করেছে, যা নিয়ে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার মানিক লাল বণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেছেন, সার্ভার আপগ্রেডেশনের কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে এটা দ্রুত কেটে যাবে। ইতিমধ্যে অনেক জেলায় সার্ভার আপগ্রেডেশনের কাজও শেষ হয়ে গেছে। ইউজার আইডিও দেওয়া হয়েছে। সিলেট, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষ জরুরি প্রয়োজনে জন্ম-মৃত্যুর সনদ নিতে পারছেন না। এমনকি পারছেন না সংশোধনও করতে। সাধারণ মানুষ সনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো থেকে তাদের জানানো হচ্ছে, সার্ভার জটিলতার কারণে এ মুহূর্তে সনদ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সমস্যা সমাধান হলে তবেই সনদ পাওয়া যাবে। মৌলভীবাজার পৌরসভার গির্জাপাড়ার একটি বস্তির বাসিন্দা রহিমা বেগম তার সন্তানকে স্থানীয় সরকারি স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে সনদ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন। তিনি সন্তানের সনদের জন্য অন্তত চার দফা মৌলভীবাজার পৌরসভায় গিয়ে সনদ পাননি। পৌরসভা থেকে তাকে জানানো হয়েছে, সার্ভার সমস্যার কারণে সনদ পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। জানা গেছে, স্কুলগুলোতে সরকারি নির্দেশনা রয়েছে, ভর্তির সময় অবশ্যই জন্মসনদ দিতে হবে। এ কারণে মৌলভীবাজার শহরের শিশু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলী আমজাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রায় সব বিদ্যালয়েই শিশু ভর্তির ক্ষেত্রে জটিলতা দেখে দিয়েছে।

মৌলভীবাজারের গিয়াসনগর ইউনিয়ন পরিষদের গিয়াসনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ জন শিশু এ বছর ভর্তি হয়েছে শিশু শ্রেণিতে। কিন্তু তাদের কারোরই জন্মসনদ দিতে পারেননি অভিভাবকরা। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লতিফা নিলুফার পাপড়ী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি নির্দেশনার কারণে তিনি জন্মসনদ ছাড়া শিশুদের স্কুলে ভর্তি নিতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তার বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য সাজ্জাদুর রহমান মনাই মিয়ার জিম্মায় ওই শিশুদের ভর্তি করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের সনদ জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউপি সদস্য। তা না হলে তাদের ভর্তি নিয়ে সংকট দেখা দেবে।

জন্ম ও মৃত্যুর সনদ নিয়ে সারা দেশে অন্তত ৩২ জেলায় এ সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। চাহিদা অনুযায়ী সনদ না পাওয়ার কারণে বিদেশগামী অনেকেই তাদের পাসপোর্ট করতে পারছেন না। চাকরির আবেদনও করতে পারছেন না অনেকে।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার দফতর সূত্রে জানা গেছে, দুই মাস ধরে বিদ্যমান সার্ভার আপগ্রেডেশনের কাজ চলছে। এ কারণে কিছুটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। রেজিস্ট্রার দফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ৩২টি জেলার সার্ভার আপগ্রেডেশনের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৩২টিতে চলমান। এ কারণে সার্ভারের গতি খুবই ধীর। ফলে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সনদ দেওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া বছরের এই সময়ে এসে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ সনদ চাওয়ার কারণে সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

ওই কর্মকর্তা জানান, সার্ভার আপগ্রেডেশনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ইউজার, অর্থাৎ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরা অনেকেই সঠিকভাবে সেটি ব্যবহার করতে পারছেন না বা বুঝতে পারছেন না। এ কারণেও জটিলতা তৈরি হয়েছে।

এদিকে নতুন জন্মসনদ নেওয়ার আরও বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। জন্মসনদ নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বেশ কিছু তথ্য প্রদান করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে নিবন্ধনকারীর টিকা কার্ড বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সনদ বা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র; পিতা-মাতার অনলাইনের জন্ম সনদ; পিতা ও মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র; বর্তমানে যে এলাকায় বসবাস করছেন সেই এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের জন্ম ও জাতীয় পরিচয়পত্র; পিতা-মাতা, পিতামহ, মাতামহীর দ্বারা স্বনামে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ঘোষিত আবাসস্থলের বিপরীতে হালনাগাদ কর পরিশোধের প্রমাণপত্র বা জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট; বর্তমান ঠিকানার জন্য যে বাসায় ভাড়া থাকেন সেই বাসার মালিকের পৌরকর পরিশোধের কপি এবং পিতা-মাতা ও নিজে ছাড়া অন্য ব্যক্তি আবেদন করলে আবেদনকারীর জন্মসনদ, জাতীয় পরিচপত্র ও মোবাইল নম্বর।

এসব তথ্য দিতে না পারলে কেউ জন্মসনদ পাবেন না। এ বিষয়গুলোকে খুবই জটিল বলে মনে করছেন মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, এসব তথ্য কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে জন্মসনদও দেওয়া যাচ্ছে না।

অবশ্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার মানিক লাল বণিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, এসব তথ্য সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। শূন্য থেকে ৪৫ দিন বয়স পর্যন্ত শিশুর সনদ নিতে কোনো কিছুই লাগবে না। ৪৬ দিন থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্মসনদ নিতে টিকা কার্ড লাগবে। আর পাঁচ বছর থেকে তদূর্ধ্ব ব্যক্তির ক্ষেত্রে জন্মসনদ নিতে অবশ্যই সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী লাগবে সব তথ্য।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনের পক্ষে এত তথ্য দেওয়া বেশ জটিল এবং সে ক্ষেত্রে তাদের ভোগান্তি হচ্ছে। এটি সমাধানের উপায় কী- জানতে চাইলে মানিক লাল বলেন, কোনো ব্যক্তি ইউনিয়ন পর্যায় থেকে যখন সনদ নেবে, তখন তার এ সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিবেচনা করে সমাধান করতে পারবেন। তিনি বলেন, কেউ যাতে দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ নিতে না পারে সে জন্য এতগুলো সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটা কোনো জটিলতা নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর