শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

যুক্তরাষ্ট্রের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গভীরভাবে বিশ্লেষণ প্রয়োজন : ড. মোমেন

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গভীরভাবে বিশ্লেষণ প্রয়োজন : ড. মোমেন

পাঁচ দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা রওনা দেওয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এ মোমেন মানবাধিকার, সুশাসন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ (দ্বৈত আচরণ)-এর সমালোচনা করে বলেছেন, গত বছর বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়েছে ১৯টি, অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে হয়েছে ১ হাজার ৪টি। একইভাবে কারাগারে নিহত হওয়ার অনেক ঘটনাই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশে বছরে একটি মৃত্যুর ঘটনায় তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

রোহিঙ্গারা যাতে সসম্মানে নিজ বসতভিটায় ফিরতে আগ্রহী হয় তেমন পরিবেশ তৈরির জন্য যে ধরনের চাপ প্রয়োগ কিংবা আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তার পরিবর্তে মিয়ানমারে যারা বিনিয়োগ ও ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সখ্য  রেখেছে। এসব বিষয় গভীরভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন।’

বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি যারা সইতে পারে না তেমন একটি মহলের যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন, ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি গেড়ে আন্তর্জাতিক অপপ্রচারণা প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, ‘সর্বশেষ বেশ নামকরা দুয়েকটি মিডিয়া মন্তব্য করেছিল যে, করোনায় বাংলাদেশে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি মানুষ মারা যাবে। বাস্তবে আমরা কী দেখলাম- আজ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৮ হাজার ৩০০। একজন মানুষও মারা যাক- সেটি আমাদের কাম্য ছিল না। আর সেজন্যই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথম থেকেই সচেষ্ট ছিলেন, আমরা সবাই তাঁর নেতৃত্বে করোনা মোকাবিলায় সোচ্চার রয়েছি বলেই মোটামুটি সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এ ধরনের আজগুবি প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে আমরা অবিচল রয়েছি বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও কল্যাণে। সচেতন প্রবাসীরাও আমাদের সাপোর্ট দিচ্ছেন। তারা কষ্টার্জিত অর্থ করোনাকালেও পাঠিয়েছেন। এ জন্য প্রবাসীদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। বাইডেন প্রশাসনের সবাই বিস্ময় প্রকাশ করে করোনা মোকাবিলার রহস্য কী জানতে চেয়েছিলেন, আমি অকপটে স্বীকার করেছি, সেটি হচ্ছেন শেখ হাসিনা। উপর আল্লাহর ইচ্ছা এবং শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় আমরা রক্ষা পাচ্ছি।’

বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা সম্পর্কে ড. মোমেন বলেন, ‘ভালো কিছু তারা চোখে দেখে না। সবকিছুকেই বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে আগ্রহী কিছুসংখ্যক লোক। এই দেখুন, দুই দিন আগে জেলে একজনের (লেখক মুশতাক আহমেদ) মৃত্যু হয়েছে। এই আমেরিকায় বহুলোক জেলে মারা যায়। তা নিয়ে কোনো নিউজ হয় না। কোনো রাষ্ট্রদূতও উদ্বেগ প্রকাশ করেন না। কানেকটিকাটে ক্লাস চলাকালে বন্দুকধারীর গুলিতে ২২টি শিশু ও শিক্ষকের প্রাণ ঝরেছে কয়েক বছর আগে। ফ্লোরিডায় স্কুলে বন্দুকধারী নির্বিচার গুলি চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক হত্যা করেছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতই ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেননি। নিজ নিজ অনুভূতি হিসেবে ‘গভীর শোক’ প্রকাশ করেছেন। এটাই রীতি। এ নিয়ে কেউ রাজনীতি করেননি। এদেশে মলের ভিতরে কতলোক গুলিতে মারা যাচ্ছে। এসব নিয়ে কেউই বিবৃতি দেন না। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব বিদেশি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তাদের ১১ জন একটি বিবৃতি দিয়েছেন কারাগারে একজনের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা চাই না বন্দীদের একজনেরও মৃত্যু। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। কেউ যদি দায়ী হয় তাহলে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এটাই প্রচলিত রীতি। যুক্তরাষ্ট্রেও তাই হয়।’

ড. মোমেন বলেন, ‘মাঝেমধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়েও শোরগোল তোলা হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার নেই, আইনের শাসন নেই বলেও কোনো কোনো সংস্থা বিবৃতিতে অভিযোগ করে। অনেক সিনেটর-কংগ্রেসম্যান আমাদের চিঠিও দিয়েছেন। এবার যারাই এমন প্রশ্নের অবতারণা করেছেন আমি তাদের সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছি যে, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অস্তিত্ব নেই। কোনো আইনেই সে ধরনের ব্যবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও নেই। জঘন্য অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতদের ধরার অভিযানের সময় র‌্যাব, পুলিশ আত্মরক্ষার্থে কখনো কখনো গুলি করতে বাধ্য হয়। তেমন পরিস্থিতিতে গত বছর মারা গেছে ১৯ জন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে ১ হাজার চারজন। আমি তাদের কাছে প্রশ্ন রেখেছি, তাহলে আপনি কী বলবেন যে ওদের ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে মেরেছেন? এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মারা গেছে ১৮ জন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে ৯৯৬ জন। সুতরাং এ নিয়ে বাংলাদেশকে অ্যাডভাইস প্রদানের সুযোগ আপনাদের নেই। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্রেরই উচিত হবে কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড কমানো যায় তেমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাহলে আমরাও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আপনাদের গৃহীত পদক্ষেপ অনুসরণ করব।’

ড. মোমেন বলেন, ‘কংগ্রেসম্যানরা কী চিঠি দিলেন সেটিকেই কিছু মিডিয়া ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশ করে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জানতে চায় না সেখানে প্রতি বছর কতজনের মৃত্যু হচ্ছে। আসলে মিডিয়ায় নেতিবাচক সংবাদের পাঠক বেশি বলে অনেক মিডিয়া-মালিকের ধারণা। অথচ সেটি কখনই কাম্য হওয়া উচিত নয়।’

নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় বহু প্রবাসী ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করছেন। এটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে সেগুলোতে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে সেগুলোর গঠনতান্ত্রিক সমালোচনা ও অসামাঞ্জস্য দূর করার পরামর্শ থাকা উচিত। কিন্তু তা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সবাই প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হেয়-প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলেই মনে হয়। এটি ঠিক নয়। বাংলাদেশ শতপ্রতিকূলতা সত্ত্বেও সমৃদ্ধির পথে ধাবিত হচ্ছে- এটিই বাস্তবতা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত বছর ৮৪ হাজার ৭৬৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অপরদিকে কানাডায় প্রতি চারজনের একজনই ধর্ষিত হচ্ছেন। অথচ সেগুলো মূলধারার মিডিয়ায় আসছে না। অপরদিকে, কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রতিদিনই এমনভাবে ধর্ষণের সংবাদ প্রচার হয়েছে যে, কানাডা থেকে একজন ফোন করে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ কী ধর্ষণের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারপরই আমি গুগল সার্চ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার উপরোক্ত তথ্য জানতে সক্ষম হই। সে সময় জানতে পারি গত বছর বাংলাদেশে মোট ৯০০ জন ধর্ষিতা হয়েছেন। আমরা চাই যে একজনও যাতে এমন বর্বরতার ভিকটিম না হন। এ জন্য মামলার পর দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে।

ড. মোমেন বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, হোয়াইট হাউসের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা, কংগ্রেসের একাধিক সদস্য এবং থিঙ্কট্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ইস্যুতে বিস্তারিত মতবিনিময় হয়েছে। বিশেষ করে জো বাইডেনের নতুন সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্ক মধুর রাখার ক্ষেত্রে আমার এ সফর ফলপ্রসূ হয়েছে বলেই মনে করছি। বাইডেন প্রশাসনের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনাকালে আমার মনে হয়েছে যে, মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে আমরা যা চাই তারাও তাই চাচ্ছেন। যেমন জলবায়ু ইস্যু, রোহিঙ্গা ইস্যু, উপমহাদেশে আমরা শান্তি ও স্থিতি চাই, আমরা শান্তিকামী, আমরা মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর, অর্থাৎ অভিন্ন ইস্যুতে আমরা পরস্পরের সহযোগী হয়ে সম্মুখে এগোতে সক্ষম হব।

ড. মোমেন বলেন, বর্তমানের বাংলাদেশ এমনভাবে পৃথিবীর সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিশ্বের যদি উন্নয়ন হয়, পৃথিবীতে যদি শান্তিশৃঙ্খলা থাকে, তাহলে আমাদেরও উন্নয়ন হয়। তিনি বলেন, করোনার সময়ে উন্নত বিশ্বেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। সে সময় আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে এক ধরনের অচলাবস্থা দেখা দেয় অনেক কোম্পানি তাদের পূর্বেকার অর্ডার বাতিল করায়। মধ্যপ্রাচ্যেও তেলের দাম কমলে এবং করোনার প্রকোপ দেখা দিলে সেসব দেশে আমাদের অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। আমরা এ জন্য সারা বিশ্বে শান্তি আর স্থিতিতে বিশ্বাসী। কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নয়।

নিউইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং-এর সঙ্গে বৈঠকের উদ্ধৃতি দিয়ে ড. মোমেন বলেন, ‘আমি তাকে অনুরোধ করেছি কংগ্রেসনাল বাংলাদেশ ককাসের নেতৃত্ব নিয়ে সেটিকে সক্রিয় করার জন্য। অভিবাসন আইনে ব্যাপক সংস্কারের সময়ে যেন বাংলাদেশিরাও সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন- সেটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। নিশা দেশাই আয়োজিত ইউএস কাউন্সিল অব চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের এক বৈঠকে অংশ নিয়েছি। সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাও ছিলেন সেখানে। সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও সুযোগ ইত্যাদি নিয়ে কথা হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর