শনিবার, ৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ডান হাতের আঙুলের ওপর বাম হাতের আঙুলের ছাপ

ভুয়া এনআইডি তৈরির নতুন তথ্য

সাখাওয়াত কাওসার

‘ডান হাতের আঙুলের ওপর বাম হাতের আঙুলের ছাপ এবং বাম হাতের জায়গায় ডান হাতের আঙুলের ছাপ বসিয়েই তৈরি হচ্ছে ভুয়া এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র)। আইডি নম্বর ঠিক রেখে ভুয়া কার্ডে বদলে ফেলা হতো ছবি এবং স্বাক্ষর। চুক্তি অনুযায়ী কাজ হাসিল না হওয়া পর্যন্ত ভুয়া কার্ডটি নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে রাখা হতো। সার্ভার আপডেট না হওয়া পর্যন্ত ভুয়া কার্ড সার্ভারেই থাকত বলে জানিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া বিপ্লব। তিনি ভুয়া এনআইডি দিয়ে বিপুল পরিমাণ আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটনায় রাজধানীর খিলগাঁও ও পল্টন থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামি। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। অন্যদিকে ভুয়া এনআইডি কার্ডগুলো কাদের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, কারা নিয়েছেন এবং কোন কোন খাতে ব্যবহার হয়েছে এসব বিষয় খতিয়ে দেখছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এসব ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত ১০০ এর মতো ভুয়া এনআইডি তৈরি করে বিভিন্ন প্রতারকের কাছে দিয়েছে। তারা এগুলো দিয়ে ভুয়া লোন, চাকরি এবং জমির ভুয়া দলিল করে নিয়েছেন। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে ভুয়া এনআইডি তৈরির কাজে ঢাকা জেলার দোহার নির্বাচন কমিশন (ইসি) অফিসের স্টাফ শাফিন, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া নির্বাচন কমিশন অফিসের স্টাফ জাকির, ঢাকার উত্তরা অফিসের সাজ্জাদ এবং প্রধান কার্যালয়ের আজিজের নাম উঠে এসেছে। এদের বেশিরভাগই চুক্তিভিত্তিক প্রকল্পে কাজ করেন। এরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই কাজ করতেন। অর্থের বড় একটা অংশ ওই কর্মকর্তাদের পৌঁছে দেওয়া হতো। 

গ্রেফতার আবদুল্লাহ বলেছেন, ইসির অসাধু কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি অন্তত ৬০টি ভুয়া কার্ড তৈরি করেছেন। আর এগুলো আনিস (ডাচবাংলা), মারুফ ও কামরুল (লংকাবাংলা), মনিরদের (এসআইবিএল) কাছে ৭০-৮০ হাজার টাকা নিয়ে সরবরাহ করেছেন। প্রতিটি কাজে তার লাভ থাকত ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। একটি টেলিকম কোম্পানিতে কাজ করেন এমন একজনকেও তিনি ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করে দিয়েছেন।

তদন্ত তদারক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশ্ন উঠছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা কেন এসব ভুয়া এনআইডি সংগ্রহ করতেন? তারা কোথায় এসব ব্যবহার করেছেন। ভুয়া লোন করিয়ে নিলে তার পরিমাণই বা কত? হাতিয়ে নেওয়া মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগই বা করেছেন কোথায়?

গ্রেফতার আল আমিন বলেন, অতীতে তিনি একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেছেন। ভুয়া এনআইডি দিয়ে তিনি যমুনা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রিমিয়ার লিজিং, পিপলস্ লিজিং থেকে অন্তত সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার লোন হাতিয়ে নিয়েছেন। হাসান ইমাম বিদ্যুৎ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি এ পেশায় এসেছেন। আবদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে একেকটি ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করে নিয়েছেন। 

জাতীয় নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ূন কবির খন্দকার এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক জানতে পারিনি। আপনাদের কাছেই শুনলাম।

ইসি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ইসির ৪৪ জনকে (চুক্তিভিত্তিক) এনআইডি জালিয়াতির কারণে বরখাস্ত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ইসির নিজস্ব স্টাফ (কর্মকর্তা/কর্মচারীর) বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও কয়েকজন জেলা ও থানা নির্বাচন কর্মকর্তার অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিষয়ে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। তবে রহস্যজনক কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, এই চক্রটি বহু লোকের এনআইডি জাল করে অনেক অবৈধ কাজ করেছে। যারা ভুয়া এনআইডি তৈরি এবং এ-সংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িত অবশ্যই আমরা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব। তিনি বলেন, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), টিন, ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে গত বুধবার রাজধানীর খিলগাঁও ও রামপুরা এলাকা থেকে মো. আল আমিন ওরফে জামিল শরীফ, খ ম হাসান ইমাম ওরফে বিদ্যুৎ, মো. আবদুল্লাহ আল শহীদ, মো. রেজাউল ইসলাম ও মো. শাহ জাহানকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ডিবি পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহীদুর রহমান রিপন জানান, আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করছি। নতুন করে পাপ্পু নামের আরেক ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমরা তাকে মামলা করে আসার পরামর্শ দিয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর