সোমবার, ৮ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

দুর্নীতির আখড়া চট্টগ্রাম কারাগার

অন্তহীন অভিযোগেও শাস্তি হয় না কারও

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

অভিযোগের শেষ নেই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার নিয়ে। বন্দী নির্যাতন, বন্দী বাণিজ্য, মাদক ব্যবসাসহ প্রতিনিয়তই নানা অভিযোগ উঠছে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এমনকি খোদ কারাগারেই কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। নানা সময় অভিযোগ উঠলেও প্রত্যেকবার অদৃশ্য শক্তির ইশারায় পার পেয়ে যান অভিযুক্তরা। সর্বশেষ গত শনিবার সুরক্ষিত সেল থেকে পালিয়েছেন হত্যা মামলার দাগি আসামি। এ ঘটনার পর ফের আলোচনায় এসেছে কারা কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মুমিনুর রহমান বলেন, ‘কারাগারের ঘটনায় দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। গঠিত তদন্ত কমিটি দুটো শুধু বন্দী পলায়নের ঘটনা নয়, কারাগার নিয়ে যত অভিযোগ আছে সবগুলোই খতিয়ে দেখবে। আশা করছি তদন্ত কমিটি বাস্তব চিত্র তুলে আনতে পারবে।’ কারাগারের এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি কারাগারের কোনো শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে কারারক্ষী থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তাই জড়িত। তাই অভিযোগ থাকলেও কোনো বিচার হয় না।’

জানা যায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার নিয়ে প্রতিনিয়তই উঠছে নানা অভিযোগ। ক্যান্টিনের অনিয়ম, বন্দী বেচাকেনা, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য, চিকিৎসা, জামিন-বাণিজ্য, বন্দী নির্যাতন, বন্দীদের খুনে সহায়তা, মাদক বাণিজ্যসহ অসংখ্য অভিযোগ করেছে কারাগারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। টাকার বিনিময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনৈতিক সুবিধা প্রদান, চাঁদাবাজির ক্ষেত্র তৈরির নানা অভিযোগ রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত শনিবার ফরহাদ হোসেন রুবেল নামে এক বন্দী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার জেলার ও এক ডেপুটি জেলারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দুই কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এর আগে গত ৫ মার্চ রূপন কান্তি নাথ নামে এক বন্দীকে নির্যাতনে জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান, জেলার রফিকুল ইসলামসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন ঝর্ণা রানী দেবনাথ নামে এক নারী। মামলার অভিযোগে বলা হয়, কারাগারে বন্দী রূপনকে স্থায়ীভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন করার জন্য শারীরিক নির্যাতন, বিষাক্ত নেশাজাতীয় দ্রব্য পুশ ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রাম বন্দরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন খান অভিযোগ করেন, শিল্পপতি পুত্র ইয়াছিন রহমান টিটু কারাগারে বসেই ব্যবসায়িক মিটিং করেন নিয়মিত। বৈঠকেই ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা মনির হোসেন খানকে মারধর করেছে। ২০১৯ সালের ২৯ মে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রেলের দরপত্র নিয়ে জোড়া খুনসহ অন্তত ১৭টি মামলার আসামি অমিত মুহুরী। এ ঘটনায় রিপন নাথ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার পর অমিতের পরিবার এটাকে কন্ট্রাক্ট কিলিং দাবি করে আসছে। যদিও এ ঘটনায় রিপনকে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়।

জেলার ও ডেপুটি জেলার প্রত্যাহার, দুজন বরখাস্ত : চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বন্দী পলায়নের ঘটনায় জেলার রফিকুল ইসলাম এবং ডেপুটি জেলার আবু সাদাতকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জেলারকে কারা অধিদফতরে এবং আবু সাদাতকে চট্টগ্রাম বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কারারক্ষী নাজিম উদ্দিন এবং ইউনুস মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া সহকারী কারারক্ষী কামাল হায়দারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে কারা অধিদফতর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কারা কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে খুলনা বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক ছগির মিয়াকে। অন্য দুই সদস্য হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগারের সুপার ইকবাল হোসেন ও বান্দরবান জেলা কারাগারের ডেপুটি জেলার ফোরকান ওয়াহিদ। গঠিত তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্তৃক তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আকতারকে প্রধান করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর