মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়াবহ ঝুঁকিতে মৎস্য হেরিটেজ হালদা

বালি উত্তোলন ও জাল বসানোয় নষ্ট হচ্ছে ডিম ছাড়ার পরিবেশ

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

হালদা নদী এখন বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ। এটি উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র। অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে নদীটির পোনার। অথচ প্রতিনিয়তই অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালি, জাল বসিয়ে ধরা হচ্ছে মা মাছ। নানাভাবে নির্যাতন-বিরক্ত করা হচ্ছে প্রাকৃতিক এ নিসর্গকে। নষ্ট করা হচ্ছে মা-মাছের ডিম ছাড়ার ইতিবাচক পরিবেশ। তদুপরি সামনেই আসছে ডিম ছাড়ার মৌসুম। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন থেকেই ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা দরকার। অন্যথায় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

অভিযোগ আছে, হালদা নদী থেকে বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ। অথচ প্রভাবশালী একটি চক্র দিনে-রাতে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে চলেছে। এ জন্য একটি পক্ষকে ম্যানেজ করে চলেছে বালি উত্তোলনকারীরা। এক নৌকা বালি তুলতে একটি চক্রকে দিতে হচ্ছে ২০০ টাকা করে। অন্যদিকে হালদা নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলও নিষিদ্ধ। তবু প্রভাবশালী একটি পক্ষ ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালিয়ে বালি উত্তোলন ও কারেন্ট জাল বসাচ্ছে। এসব কারণে নষ্ট হচ্ছে মা-মাছ অবস্থানের পরিবেশ। নদী রক্ষায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না জাল বসানো ও বালি উত্তোলন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, সামনে আসছে হালদা নদীতে মা-মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম। তাই এখন থেকেই নদীর পরিবেশ মা-মাছবান্ধব রাখতে হবে। ডিম ছাড়ার পরিবেশ নষ্ট হলে আশানুরূপ ডিম পাওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে সবাইকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, অভিযান রুটিনকাজ। কিন্তু অভিযান দিয়ে হালদা রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন হালদাপাড়ের মানুষদের নদীর প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। যত দিন পর্যন্ত হালদাপাড়ের মানুষের মধ্যে এ বোধটুকু আসবে না, তত দিন প্রকৃত অর্থেই এ নদীকে বাঁচানো কঠিন হবে। একই সঙ্গে হালদাকে ব্যবসাকেন্দ্র না বানিয়ে প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ করতে মা-মাছ নিধন ও বালি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।

জানা যায়, হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ঐতিহ্য’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বৃহস্পতিবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে জীববৈচিত্র্য বিষয়ক জাতীয় কমিটির প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্তের ফলে হালদা নদীতে কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করা, ডলফিন সুরক্ষা, দূষণ কমানোসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণ সহজ করতে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিনই হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন হালদা নদীর সর্তার ঘাট থেকে কালুরঘাট মুখ পর্যন্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাড়ে চার হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করে। যখনই অভিযান পরিচালিত হয় তখনই জব্দ করা হয় কারেন্ট জাল আর অবৈধভাবে বালি উত্তোলনে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম। ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন হালদা নদীর দূষণ রোধ ও মা-মাছ রক্ষায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। বন্ধ করা হয়েছে হালদা দূষণের অন্যতম কারণ হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট ও এশিয়া পেপার মিল।

ইতিমধ্যে পরিচালিত ১৫৯টি অভিযানে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে তিনজনকে। জব্দ করা হয় ২ লাখ ৭৩ হাজার মিটার জাল ও ১ লাখ ১৫ হাজার ঘনফুট বালি। জব্দ করা হয় ঘেরাজাল বসানোর কাজে ব্যবহৃত পাঁচটি নৌকা, ধ্বংস করা হয় ১৫টি ড্রেজার ও ৫০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা এবং বালি উত্তোলনে ব্যবহৃত ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার পাইপ। নিলামে বিক্রি করা হয় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকার বালু, জরিমানা করা হয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এক দিনের অভিযানেই ইঞ্জিনচালিত ১২টি নৌকা থেকে বালি উত্তোলনে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জব্দ এবং ইঞ্জিন ধ্বংস করার ঘটনাও আছে।

সর্বশেষ খবর