মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার চান সিমেন্টশিল্প মালিকরা

এনবিআরে প্রস্তাব বিসিএমএ’র

নিজস্ব প্রতিবেদক

অস্তিত্ব সংকটের মুখে থাকা সিমেন্টশিল্প রক্ষায় আগামী বাজেটে বিদ্যমান তিন শতাংশ অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম আয়কর ও তিন শতাংশ সরবরাহ কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়েছে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিসিএমএ। মালিকদের এ সংগঠনটি বলেছে, সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত মৌলিক কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে শুল্ককর প্রতি টন ৫০০ টাকার পরিবর্তে পাঁচ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা হোক। এ ছাড়া সমন্বিত অগ্রিম আয়কর হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা হওয়া প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা দ্রুত ফেরত বা ছাড় দিতে এনবিআরের হস্তক্ষেপ চেয়েছে বিসিএমএ। সংগঠনটি আরও বলেছে, দেশের সিমেন্টশিল্প এক অস্থিতিশীল সময় পার করছে। একদিকে গত এক বছর করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাব, অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের অস্বাভাবিক ও অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের সিমেন্ট খাতে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে দেওয়া প্রস্তাবে এসব কথা বলেন বিসিএমএ সভাপতি মো. আলমগীর কবির। গত ১৬ মার্চ এনবিআরকে দেওয়া প্রস্তাবে তিনি বলেন, সিমেন্টের সব কাঁচামালই আমদানিনির্ভর। তাই আমদানি শুল্ক, মূসক ও কর সবই কর্তন হয় আমদানি পর্যায়ে। আমরা বারবার অনুরোধ করে আসছি, সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ন্যূনতম মুনাফা বেঁধে দিতে পারে না। অথচ এ সিমেন্টশিল্পে তিন শতাংশ অগ্রিম আয়কর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যা সমন্বয় বা ফেরতযোগ্য নয়, অর্থাৎ চূড়ান্ত দায়। এটি গণতান্ত্রিক পন্থায় শুধু ভুল বলব না, অন্যায়ও বটে। এ খাতের অন্যতম মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের শুল্কায়ন করা হয় ৫০০ টাকা প্রতি টনে, যা প্রায় ১১ শতাংশ। অথচ ইন্টারমিডিয়েট কাঁচামাল হিসেবে, এটি কোনোভাবেই পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত না। বিগত কয়েক বছরে সিমেন্টশিল্পে অগ্রিম আয়কর হিসেবে সমন্বয়যোগ্য বা ফেরতযোগ্য যে অর্থ এনবিআরের কাছে জমা রয়েছে, তা আমরা ফেরত পাচ্ছি না। বর্তমানে পুঞ্জীভূত টাকার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে পুঁজি সংকটের এটি অন্যতম কারণ। অথচ আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ১৪৬ নম্বর সেকশন অনুযায়ী করদাতার পরিশোধিত টাকা পরিশোধযোগ্য করের চেয়ে বেশি হলে তা ফেরত পাওয়ার যোগ্য। ফেরত দিতে দেরি হলে সরকার যতক্ষণ না তা ফেরত দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর সাড়ে সাত শতাংশ হারে সুদ প্রদান করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ ফেরতযোগ্য টাকাগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে এবং বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও তা ফেরত পাওয়া যায় না।

বিসিএমএ বাজেট প্রস্তাবে বলেছে, নভেল করোনাভাইরাস সিমেন্টশিল্প খাতে বড় ধরনের আঘাত হানলেও শ্রমিক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কোনোভাবেই বন্ধ করা হয়নি বা কমানো হয়নি। তাই পুঞ্জীভূত অগ্রীম আয়করের টাকাগুলো দ্রুত ফেরত বা ছাড় করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে আকুল আবেদন জানান শিল্প মালিকরা। এর ফলে অর্থাভাবগ্রস্ত কোম্পানিগুলো কিছু নগদ অর্থের সরবরাহ পাবে এবং এই কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থায়নের খরচ কিছুটা কমিয়ে আনতে পারবে। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে কিছু সিমেন্ট রপ্তানি করা হচ্ছে, যা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু রপ্তানি-পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ডেডোতে জমা দেওয়ার পরও বছরব্যাপী সিদ্ধান্তহীনভাবে পড়ে থাকে। তাহলে রপ্তানি করার যে উৎসাহ সেটা তো আর থাকবে না। করপোরেট সেক্টর থেকে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত তাদের কর হার অত্যন্ত বেশি। তার ওপর ব্যক্তির লভ্যাংশ থেকে পুনরায় কর কেটে নেওয়া হয়। একই খাত থেকে মোটা অংকের দ্বৈত কর থাকার কারণে উদ্যোক্তারা পুঁজি সংকটে ভোগেন। তাদের ইকুইটি কাক্সিক্ষত মাত্রায় না থাকায় নতুন কিছু করার সুযোগ থাকলেও তা করতে পারছেন না। এতে মূলত দেশের ক্ষতি হচ্ছে। বিসিএমএ বলেছে, আমরা যদি কোনো দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অথবা উন্নয়ন দেখি, তাহলে সেই দেশের মাথাপিছু সিমেন্ট ও স্টিল ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। মূলত সিমেন্ট ও স্টিল ছাড়া কোনো দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন অসম্ভব। এ দুটি পণ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হয় বেশি করে। কারণ, যারা উন্নতি করেছে, তাদের সঙ্গে তুলনা করলেই এর গুরুত্ব বোঝা যাবে। যেমন, চীনে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ১ হাজার ৭০০ কেজি, মালয়েশিয়ায় ৮৯০ কেজি, থাইল্যান্ডে ৬২০ কেজি, ভিয়েতনামে ৫১৮ কেজি, পার্শ্ববর্তী ভারতে ৩২৫ কেজি, শ্রীলঙ্কায় ৪১২ কেজি এবং বাংলাদেশে ২১০ কেজি। প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এ খাতে। অথচ গুরুত্ব একেবারেই কম। আমাদের দেশের রাজস্ব আহরণ যারা করে থাকেন, তাদের বেশির ভাগই চেষ্টা করেন সোর্স বা উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করতে। যেন মাঠপর্যায়ে যেতে না হয়। তাই পরিধি না বাড়িয়ে উৎসে কর আদায় করার একটি অলিখিত নিয়ম চলছে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে এ পরিধি বাড়াতেই হবে। নয় তো সোর্স বা উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করা হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টার্গেট ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটি ঘটেছে এ সিমেন্ট সেক্টরে। শিল্প মালিকদের মতে, বাংলাদেশে সিমেন্ট উৎপাদনের সব কাঁচামাল বিদেশনির্ভর। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য তারতম্য হলে তার প্রভাব দেশে পড়ে। যেমন বিগত দুই মাস আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর বড় কারণ পরিবহন বা জাহাজ ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতি মেট্রিক টন পরিবহন ব্যয় ছিল ১১ ডলার, যা বর্তমান সময়ে চলছে ২৩ ডলার। এ অবস্থা ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সিমেন্ট শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫টির মতো দেশি-বিদেশি কোম্পানি সিমেন্ট উৎপাদন করছে। দেশে সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন, যার বিপরীতে প্রায় ৮ দশমিক ৪ কোটি মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। এ খাতে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তাছাড়া, এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কয়েক লক্ষাধিক নির্মাণশ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। বছরে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি এ খাত থেকে সরকারি কোষাগারে শুল্ক-করের মাধ্যমে জমা করা হয়। দেশে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশেও সিমেন্ট রপ্তানি হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর