বুধবার, ২৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

রমজান সামনে রেখে পণ্যমূল্য বাড়ার ১১ কারণ চিহ্নিত

আলী আজম

রমজান সামনে রেখে পণ্যমূল্য বাড়ার ১১ কারণ চিহ্নিত

স্বল্পমূল্যের টিসিবির পণ্য কিনতে উপচে পড়া ভিড়। ছবিটি গতকাল রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে তোলা - বাংলাদেশ প্রতিদিন

রমজান মাস সামনে রেখে ১১টি কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে। সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এসব কারণ উদঘাটন করেছে গোয়েন্দারা। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেওয়া হবে। রমজানে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে থানা ও জেলা পর্যায়ে টিসিবির কার্যক্রম বেগবান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করাসহ সরকারের কাছে ১০ দফা সুপারিশ করেছে ওই সংস্থাটি। সংস্থাটির আশঙ্কা, রমজানকে ঘিরে চালের বাজারে আরেক দফায় অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।

১১টি কারণ হলো- প্রথাগত বাজার সরবরাহ প্রক্রিয়া, অতিরিক্ত মজুদের মাধ্যমে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, অপর্যাপ্ত ও সমন্বয়হীন বাজার মনিটরিং, রমজানে পণ্যের বাড়তি চাহিদা, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, যানজট ও অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয়, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদের হার, ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা এবং ব্যবসা পরিচালনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়া। সূত্র মতে, রমজানকে সামনে রেখে অসাধু সিন্ডিকেট সদস্যরা চাল, ছোলা, ডাল, সবজি, মসলা, ভোজ্যতেল, খেজুর, চিনি, ডাল, পিঁয়াজ, মাছ-মাংস এবং গুঁড়া দুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম গত দুই মাসে ধাপে ধাপে বাড়িয়েছে। এই দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি ছোলা সর্বোচ্চ ১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতি কেজি সাধারণ মানের খেজুর ১৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রতি কেজি চিনি ১০ টাকা, মুগডাল ১০ টাকা ও দেশি পিঁয়াজ ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস দুই মাসের ব্যবধানে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

 প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৫ টাকা বেড়েছে। গুঁড়া দুধ কোম্পানিভেদে কেজিতে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ৯ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বর্তমানে বাজার চাহিদার ৮-১০ শতাংশ জোগান দেয়। টিসিবির ওপর সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেশি। তাই বাজার স্থিতিশীল রাখতে টিসিবির সেবার পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি টিসিবিকে এখনই নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্রেতাসাধারণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আমদানিকারক এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেশে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেন। প্রকৃত অর্থে দেশে উৎপাদিত পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। দ্রব্যমূল্যের চলমান ঊর্ধ্বগতি রোধ করা না গেলে রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। তখন ভোক্তাসাধারণ দুর্ভোগের শিকার হবে।

এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।

চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এবার আমন চালের ফলনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ কারণে চালের বাজার চড়া রয়েছে। সরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হলেও চালের মূল্য এখনো ক্রেতাসাধারণের সহনীয় পর্যায়ে অসেনি। রমজানে চালের চাহিদা অপরিবর্তিত থাকলেও এর বাজার আরেক দফা অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেগুন, শসা, গাজর ও মাছ-মাংস উৎপাদনে দেশীয়ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু রমজানে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মূল্য মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। স্বাভাবিক সরবরাহ, পরিবহন, বিপণন ও বাজার মনিটরিং নিশ্চিত করা গেলে এসব পণ্যের বাজার সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। অন্যথায় অসহনীয় হওয়ার আশঙ্কা আছে। রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদাকে পুঁজি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজার অধিকতর অস্থিতিশীল করে তোলে। তাই এ বিষয়ে আগে থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাজার নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা সংস্থার ১০ দফা সুপারিশে বলা হয়েছে, টিসিবিকে অধিকতর কার্যকরের পাশাপাশি মহানগরসহ জেলা ও থানা পর্যায়ে টিসিবির কার্যক্রম বেগবান করতে হবে। পণ্যের আমদানি ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানিকারকদের ভোগ্যপণ্যের এলসি মার্জিন ও আমদানি শুল্ক কমাতে সহায়তা দানে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনাসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। আমদানিনির্ভর সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ মনিটরিংয়ের আওতায় এনে সরকারিভাবে মজুদ বাড়াতে হবে। নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেশের সব বাজারে নিয়মিত মূল্য তালিকা হালনাগাদকরণ ও প্রদর্শন কার্যক্রম নিশ্চিতের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পণ্য সংকটের অজুহাতে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা যেন পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

গোয়েন্দা সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, পণ্যের আমদানি ও উৎপাদনস্থল থেকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা হয়ে ভোক্তার হাতে পৌঁছা পর্যন্ত মূল্য পার্থক্য কমিয়ে আনতে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতাদের কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। মজুদদারি ও কালোবাজারি বন্ধে ভ্রম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি গুজবের মাধ্যমে কেউ যেন বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সরকার যেসব পণ্যের মূল্য তালিকা নির্ধারণ করেছে সেসব পণ্যের দাম যেন বিক্রেতারা নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়াতে না পারে সে বিষয়টি কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে চালের চাহিদা ৩ কোটি ৩৯ লাখ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে বছরে উৎপাদন প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ মেট্রিক টন। সেই বিবেচনায় চাল উদ্বৃদ্ধ থাকার কথা থাকলেও মিল মালিকরা বাজারে চাল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। আসন্ন রমজানে চালের চাহিদা ২৯ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে সরকারি গুদামে ৫ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২১ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ১ দশমিক ৭ লাখ মেট্রিক টন। বাকি চাহিদা পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। রমজান মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২ লাখ মেট্রিক টন। বাজার নিয়ন্ত্রণে রমজান মাসে টিসিবি ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ভোজ্যতেল আমদানি করার উদ্যোগ নিয়েছে। যা রমজানে চাহিদার ১৭ দশমিক ৫ ভাগ। বিশ্ব মহামারীর কারণে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে দাম বেড়েছে। তাই আমাদের দেশেও এর দাম বেড়েছে।

 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে পিঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু পিঁয়াজ উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত স্থানীয় উৎপাদিত পিঁয়াজের ১৫ ভাগ এবং আমাদানিকৃত পিঁয়াজের ১২ থেকে ১৫ ভাগ প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্ষতি হয়। এ কারণে বছরে ১২ থেকে ১৪ লাখ মেট্রিক টন পিঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। রমজানে দেশের বাজারে ৫ লাখ মেট্রিক টন পিঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। রমজানকে সামনে রেখে টিসিবি ৫ হাজার মেট্রিক টন পিঁয়াজ সরবরাহ করবে। এপ্রিল মাস পর্যন্ত দেশি পিঁয়াজের মৌসুম থাকায় রমজানে পিঁয়াজের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকবে।

রমজানে ৩ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। বাজার মনিটরিং যথাযথ হলে চিনির মূল্য স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা আছে। রমজানকে ঘিরে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ছোলার চাহিদা রয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবি ৮ হাজার মেট্রিক টন ছোলা সরবরাহ করবে। এছাড়া টিসিবি ১৫ হাজার মেট্রিক টন মসুর ডাল সরবরাহ করবে। তারপরও রমজানে ছোলা ও ডালের দাম বাড়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশে মসলার বাজার আমদানিনির্ভর। করোনা মহামারীর কারণে এর আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে দেশে মসলার বাজার চড়া। রমজানে মসলার বাজার আরও বেড়ে যেতে পারে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। চাহিদার তুলনায় দেশে মাছ-মাংসের সরবরাহ বেশি। বাজার মনিটরিং সঠিক হলে রমজানে মাছ-মাংসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর