মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বরিশালের নদ-নদীতে ঢুকেছে সামদ্রিক লবণাক্ত পানি

রাহাত খান, বরিশাল

বরিশালের নদ-নদীতে ঢুকেছে সামদ্রিক লবণাক্ত পানি

বরিশালের কীর্তনখোলাসহ বরিশালের বিভিন্ন নদীতে প্রবেশ করেছে লবণাক্ত পানি। গতকাল ছবিটি কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বরিশালের নদ-নদী, খাল-বিলে ঢুকে পড়েছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি। গত কয়েক দিনে কীর্তনখোলা নদী ছাড়িয়ে তেঁতুলিয়া ও মেঘনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি; যা গত অর্ধশতাব্দীতেও দেখেনি কেউ। নদীর পানিতে গোসল করলে চুল আঠা হয়ে যায়। এ পানি দিয়ে বানানো চা নোনতা লাগে। মাছ, কৃষিসহ জীববৈচিত্র্যেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে দাবি পরিবেশবিদদের। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের। তারা বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখে কারণ অনুসন্ধানের কথা বলেছেন। উজানের পানির চাপ কমার পাশাপাশি সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি বরিশাল ছাড়িয়ে উত্তরাঞ্চলেও প্রবেশের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আগেই প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে উজানের সব নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ের দাবি তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জোয়ার-ভাটার তারতম্যের কারণে সমুদ্রে জোয়ারের সময় উপকূলীয় ২২ জেলার নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়ত সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি। বরিশালের নদ-নদীগুলো আগে মিঠা পানি আধার হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরে লবণাক্ত পানির অস্তিত্ব পাচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। কীর্তনখোলা, তেঁতুলিয়া ছাড়িয়ে মেঘনায়ও ঢুকে পড়েছে লবণাক্ত পানি।

কীর্তনখোলা নদীতীরবর্তী মানুষজন জানান, কীর্তনখোলার পানি মুখে নিলে নোনতা লাগছে। নদীর পানি দিয়ে বানানো চা-ও নোনতা। নদীর পানিতে গোসল করলে চুলও হয়ে যায় আঠালো; যা বরিশালের ইতিহাসে বিরল। গত ৫০ বছরেও এমন দেখেননি বরিশালের মানুষ। শুধু কীর্তনখোলা নয়, মেহেন্দিগঞ্জের মেঘনা নদীর পানিও লবণাক্ত হয়ে গেছে। ওই নদীর পানি দিয়ে বানানো চা-ও লবণাক্ত লাগছে বলে জানিয়েছেন চা বিক্রেতা রেজাউল কবির।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সবুজ বরিশাল’-এর সংগঠক মো. মিজানুর রহমান জানান, উজানের পানিপ্রবাহ কমার কারণে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলের ২২ জেলা ছাড়িয়ে লবণাক্ত পানি ২৩তম জেলা হিসেবে বরিশালের নদ-নদীতে ঢুকেছে। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যায় পড়বেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সংগঠক মো. রফিকুল আলম জানান, কয়েকদিন ধরেই বিভিন্ন স্থান থেকে খবর পাচ্ছেন কীর্তনখোলাসহ বরিশালের বিভিন্ন নদ-নদীতে লবণপানির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। উজানের পানির ফ্লো কমে যাওয়ায় সাগরের নোনা পানি ধীরে ধীরে উজানের দিকে আসছে। এ ব্যাপারে এখনই সরকারকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী করণীয় বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। লবণাক্ততার কারণে মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে কৃষি, জলজ প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করেন এই পরিবেশবিদ।

বরিশালের নদ-নদীতে মাত্রাতিরিক্ত লবণপানি প্রবেশ করায় বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। বরিশাল পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী বায়োক্যামিস্ট মো. মুনতাসির রহমান জানান, গত মার্চে কীর্তনখোলার পানির ইলেকট্রিক্যাল কন্ড্যাকটিভিটি ছিল ১৩৬২ সিমেন্স পার মিটার কিউব; যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। বিষয়টি দুশ্চিন্তার। তারা আরও নমুনা সংগ্রহ করে তদারকি অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন।

বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কামরুজ্জামান সরকার জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কীর্তনখোলা নদীর ইলেকট্রিক্যাল কন্ড্যাকটিভিটি খুবই কম ছিল। হঠাৎ মার্চে নদীর পানিতে ইলেকট্র্রিক্যাল কন্ড্যাকটিভিটি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এটা দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা তার। উজানের নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে ওইসব নদী খনন করে নাব্য বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে লবণাক্ত পানি প্রবেশের জন্য উজানের পানির প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলবিদ্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নদীতেও সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। নদীতে লবণাক্ত পানির উপস্থিতি ঠেকাতে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে উজানের সব নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ের জন্য সরকারের কাছে দইব জানিয়েছেন ড. হাফিজ আশরাফুল হক।

সর্বশেষ খবর