রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বরেন্দ্র অঞ্চলে নামছে পানির স্তর

পাঁচ বছরে স্তর নেমেছে ৫০ ফুট, পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছে ওয়ারপো

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

বরেন্দ্র অঞ্চলে নামছে পানির স্তর। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর রেকর্ড পরিমাণে ১৫০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় অকেজো হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপ। গভীর নলকূপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না। বৈশাখের এই খরতাপে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন। তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার তথ্য।

সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় তানোরের মুন্ডুমালা পৌরভবনের পাশে ২০১৬ সালে ডাসকো পানি মাপার কূপ তৈরি করে। কূপ বসানোর সময় সেখানে পানির স্তর ছিল ১০০ ফুট নিচে। কূপের ভিতর একটা ডিভাইস পাঠিয়ে গভীরতা পরিমাপ করা হতো। ডিভাইসটি নিচে গিয়ে পানি স্পর্শ করলেই উপরে ডিভাইসের বেল বাজত। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মাটির ১৫০ ফুট নিচে গিয়েও আর ডিভাইসের বেল বাজছে না। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে পানির স্তর নেমে গেছে ৫০ ফুট।

ডাসকোর কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এক যুগ আগেও এসব অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৫০ ফুট বা তারও নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গবেষকরা বলছেন, কৃষিকাজের জন্য বরেন্দ্র এলাকায় অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলার কারণে পানির স্তর প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিন ফুট নেমে যাচ্ছে। ১৯৮০ সালেও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর মাটির মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটা পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান ২০১৪ সাল থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি সরকারের পানি বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য। তিনি বলেন, ধান চাষের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার এই উঁচু ও শুকনো অঞ্চলে পানীয় জল দুষ্প্রাপ্য করে তুলতে পারে। পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নিচে বালু, পাথর ফাঁকা হয়ে পড়বে। তখন সামান্য ভূমিকম্প হলেই দেবে যেতে পারে বিশাল এলাকা। বৃষ্টির পানি বেশি বেশি রিচার্জ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর-খাড়ি বেশি করে খনন করতে হবে। বাসাবাড়ির ছাদের পানি মাটির নিচে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় সরকারের পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। ‘অপারেশনালাইজিং ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে ওয়ারপো। প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গত ১৯ মার্চ ওয়ারপো রাজশাহীতে অফিস চালু করেছে। এ ছাড়া রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদহ ইউনিয়নে একটি পানি মডেলিং প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা আছে। ওয়ারপোর মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, এই প্রকল্পের আওতায় ওয়ারপো ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানিসম্পদের মানচিত্র তৈরি করবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পানির প্রাপ্যতা এবং পর্যাপ্ততা পরিমাপ করবে এবং এগুলো সুরক্ষিত করবে। এটি ব্যক্তিগত, কৃষি ও শিল্প খাতে পানির চাহিদা নির্ধারণ করবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির নিরাপদ উত্তোলন সীমা চিহ্নিত করবে এবং এভাবে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কর্মকর্তারা জানান, বরেন্দ্র এলাকায় এখন ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকূপ আছে। ২০১২ সালের দিকে সরকার কৃষিকাজের জন্য আর ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর থেকে বিএমডিএ নতুন করে আর নলকূপ বসাচ্ছে না। ভূ-উপরিস্থ পানির আধার সৃষ্টি করতে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক খাল ও খাড়ি সংস্কার এবং খনন করলেও তা কাজে আসছে না। ফলে কৃষকদের ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সম্প্রতি বিএমডিএর এক হিসাব অনুসারে, বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩,৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার, যার প্রায় ৭০ শতাংশই বেসরকারি গভীর নলকূপ দিয়ে উত্তোলিত হচ্ছে। প্রকৌশলীদের হিসাব অনুযায়ী, এই পরিমাণ পানি এক বিঘা আয়তনের দুই মিটার গভীরতাবিশিষ্ট ১৮ লাখ পুকুর ভরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর