শুক্রবার, ৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

সামাজিক-মানসিক চাপে বাড়ছে অপরাধ

জিন্নাতুন নূর

সামাজিক-মানসিক চাপে বাড়ছে অপরাধ

করোনা মহামারীতে দেশে ধর্ষণ, হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়ছে। খুব দ্রুত মানুষের মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা প্রতিটি লোকের স্বাভাবিক জীবনের যে গতি ছিল তা নষ্ট করে দিয়েছে। ঘরবন্দী হয়ে এবং অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে মানুষের মধ্যে সামাজিক ও মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে। আর মাত্রাতিরিক্ত এই চাপ সহ্য করতে না পেরে রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সমাজে নানা রকম অপরাধের ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারীর কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় অপরাধীরা সবসময়ই এখন অপরাধ ঘটানোর সুযোগ খুঁজছে। এ সময় অপরাধীরা অপরাধ করেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়বে না এমনটি মনে করছে। অর্থাৎ মহামারী তাদের অপরাধ ঘটানোর জন্য ইন্ধন জোগাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪৬ জন নারী তাদের স্বামীর নির্যাতনের কারণে মারা যান। এ সময় মোট পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন ৬৮ জন। স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন ১১ জন। এই তিন মাসে মোট ২৩৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর মৃত্যু হয় ১০ জনের। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন চারজন নারী। একই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হন ২২ জন। আর যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেন তিনজন নারী। এ ছাড়া এই সময়ে মোট ২৩৯ জন শিশুর ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করা হয় আর ১৪৪ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। মনোবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, অতিরিক্ত এই চাপ সবাই যে সহ্য করতে পারবেন এমন নয়। এ জন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কোনোভাবেই অপরাধীরা যেন পার পেয়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা বলেন, এই মহামারীর আগে যেভাবে আমাদের জীবনটা কাটিয়েছি তা এখন আর পারছি না। এখন অনেক কিছুই সীমিত হয়ে পড়েছে। আগে স্বাভাবিক জীবনযাপনের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক চাপ কমানোর সুযোগ ছিল কিন্তু জীবনযাপন এখন আর স্বাভাবিক না থাকায় অনেক সময়ই মানসিক চাপ কমাতে পারছেন না মানুষজন। মানুষের ভবিষ্যৎও অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যা মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারীতে এখন অস্বাভাবিক বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে। এর আগে এই ধরনের পরিবেশের কথা আমরা কল্পনাও করিনি। করোনার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্য নয়, আমাদের মনস্তত্ত্ব, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং পারিবারিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোও জড়িত। এই পরিস্থিতিতে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হচ্ছে। এ ধরনের অতি অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন এবং অতি সংশয়পূর্ণ জীবনের সঙ্গে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্তি¡ক বিষয়গুলোও জড়িত। সামাজিক দূরত্ব সীমিত পরিসরের মধ্যে আমাদের বন্দী করে রেখেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মনস্তত্ত্বে চাপ পড়ছে। এর কারণ আমরা সবাই যেভাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি তার থেকে এখন একেবারেই বিপরীতমুখী জীবনযাত্রায় চলে গিয়েছি। পরিবারের ভিতরেও এই চাপ বাড়ছে। দাম্পত্য জীবনে ছোট ঝগড়া খুনাখুনিতে রূপ নিচ্ছে। আয় উপার্জন কমে আসায় অনেক পরিবার গ্রামে চলে যাচ্ছে। দিন আনে দিন খায় মানুষগুলো প্রচন্ড জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আর এই সব কিছুই সমাজে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের জন্য পরিবেশ তৈরি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. মাহফুজা খানম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহামারীতে ঘরবন্দী হয়ে পড়ায় অনেকেই এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তারা যে কোনোভাবেই হোক এই চাপ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। এই পথকে আমরা ‘কোপিং স্ট্র্যাজেজি’ বলি। মানসিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার দুটি পথ আছে কেউ এডাপ্টিভ পথ খুঁজে নেয়। সেখানে একজন ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় অপেক্ষা করতে শেখে।  আবার আরেকটি পথে একজনের মধ্যে যে রাগ, হতাশা জমা হচ্ছে তা ভুল পথের মাধ্যমে হলেও নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। ধর্ষণ এই স্টেজের একটি নেতিবাচক আউটলেট। একজন ধর্ষক যখন তার অতিরিক্ত মানসিক চাপ নিতে পারে না তখন তার মাথার মধ্যে নেতিবাচক বিষয়গুলো ঘুরতে থাকে। এ অবস্থায় নিজের রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ধর্ষকটি একটি সুযোগ খুঁজে। আর তখন ধর্ষণের মতো অপরাধ করেই নিজের রাগ-ক্ষোভের কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একইভাবে একজন হত্যাকারীও হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ ঘটিয়ে নিজের রাগ-ক্ষোভের প্রকাশ ঘটায়। তিনি আরও বলেন, আমাদের বুঝতে হবে যে করোনা সংক্রমণের মধ্যে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বেই। এ ছাড়া মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও কমে আসছে। এটিও অপরাধ ঘটানোর অন্যতম কারণ। এ বিষয়গুলোর জন্য মানুষের মধ্যে এক ধরনের চাপ আছে। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে নৈতিকতা মানুষকে ধৈর্য ধরতে শেখায়। বিশেষ করে মানসিক চাপ কমানোর জন্য যদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে কাজে লাগানো যায় তাহলে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় অনেকটা কমে আসবে। ভক্তি ও সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখার মাধ্যমেও অনেক সময় মানসিক চাপ কেটে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, করোনা মহামারীতে সব শ্রেণি-পেশার লোকজন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলোর মধ্যে নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকা মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় কমবয়সীরা দল বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছে। যাপিত জীবনের যে যাত্রাটি ছিল সে জায়গা থেকে আমরা অন্য জায়গায় চলে গিয়েছি। সেখানে খাপ খাওয়ানো খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থের অভাব থেকে তীব্র থেকে তীব্রতর সংকট তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ সামাজিক, মনসিক ও পারিবারিক চাপে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর