মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ

পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে, যা বাস্তবায়ন হলে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী এ ফসলের বীজ আর আমদানি করতে হবে না। উপরন্তু কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন থেকে কৃষকদের ভর্তুকিমূল্যে দেওয়া হবে পাটবীজ। স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর কৃষক যাতে লাভবান হয় সে কারণে দেশে পাটবীজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রকল্প শেষে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিকটন প্রত্যয়ন বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জিত হবে। সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বিষয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় এ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয় বলে জানা গেছে। গত ১৯ মে ওই সভার কার্যবিবরনী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁচ দশক আগেও দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। রপ্তানি করে আয় হতো মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এ কারণে নাম ছিল সোনালি আঁশ। অথচ প্রয়োজনীয় বীজের অভাবে পরিবেশবান্ধব গুরুত্বপূর্ণ এ ফসলটির উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশে পাটের আওতায় মোট আবাদের ৯০ ভাগ জমিতে তোষা পাট, ৬ ভাগ জমিতে কেনাফ এবং ৪ ভাগ জমিতে দেশি পাটের আবাদ হয়। সে হিসাবে দেশে মোট সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিকটন তোষা পাটবীজ প্রয়োজন।  কর্মকর্তারা জানান, প্রতি হেক্টর জমিতে পাট আবাদে পাঁচ থেকে সাত কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশে উৎপাদিত বীজের মাধ্যমে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়। বাকি চাহিদার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভারতীয় বীজের মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে। এখন এ ভারতীয় পাটবীজ প্রতিস্থাপন করে উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম এবং উৎপাদনে দ্বিতীয়। দেশে প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে ৮০ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। উৎপাদন মৌসুমে প্রায় ৯০ শতাংশ পাটবীজ আমদানি করতে হয়। যার সিংহভাগই আসে ভারতে থেকে। আমদানি নির্ভরতার কারণে প্রতি বছরই ঝুঁকিতে থাকে উৎপাদন কার্যক্রম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৮২ লাখ ৮৩ হাজার টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে চাষ হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে। করোনার কারণে দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবাদ মৌসুমে ভারত থেকে পাট বীজ আমদানি করা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত অর্থবছরে ভারত থেকে সাড়ে ৪ হাজার টনের বেশি পাট বীজ আমদানি হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে সেই বীজ সময়মতো দেশে আসতে পারেনি। সময়মতো বীজ না আসায় পাটের উৎপাদন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ কমে গেছে। ফলে এর প্রভাব পড়েছে কাঁচা পাটের বাজারে।

যেভাবে পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ : গত ২৯ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত পাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বিষয়ক অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় বিএডিসির উপপরিচালক (পাটবীজ) একটি প্রকল্প প্রস্তাব তুলে ধরে জানান, ৬৭৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন হবে। ৫ বছর মেয়াদি ওই প্রকল্প থেকে প্রথম বছরে ৩০০ কেজি, দ্বিতীয় বছরে ৬০০ কেজি, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে ৯০০ কেজি করে প্রজনন মানের বীজ বিএডিসিকে সরবরাহ করা হবে।

প্রজনন মানের বীজ থেকে বিএডিসি প্রথম বছরে ২০ মেট্রিকটন ভিত্তিমানের বীজ, দ্বিতীয় বছর ৪০ মেট্রিকটন ভিত্তিমানের বীজ ও ১ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন প্রত্যায়িত মানের বীজ, তৃতীয় বছর ৬০ মেট্রিকটন ভিত্তিমানের বীজ ও ৩ হাজার মেট্রিকটন প্রত্যায়িত মানের বীজ, চতুর্থ বছর ৬০ মেট্রিকটন ভিত্তি মানের বীজ ও ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন প্রত্যায়িত মানের বীজ এবং পঞ্চম বছরে চতুর্থ বছরের সমপরিমাণ বীজ উৎপাদন করবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর প্রথম বছরে বীনামূল্যে বীজ বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজারটি, দ্বিতীয় বছরে বীনামূল্যে ৫ হাজারটি, তৃতীয় বছরে বীনামূল্যে ৬ হাজারটি এবং চতুর্থ বছর ভর্তুকিমূল্যে ৬ হাজার ৫০০টি ও পঞ্চম বছরে ভর্তুকিমূল্যে সমপরিমাণ প্রদর্শনী প্লট করবে। ভর্তুকিমূল্যে প্রতি কেজি বীজের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ১০০ টাকা। বিএডিসি চারটি বিভাগের ১৩টি জেলার ৫৯টি উপজেলায়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছয়টি বিভাগের ২০টি জেলার ৫০টি উপজেলায় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ছয়টি বিভাগের ৪৩টি জেলার ১৯৮টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।  কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ব্যয় ও সময় কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি পাঁচ বছরের পরিবর্তে তিন বছরের মধ্যে পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্য নিতে বলেছেন। এ ছাড়া প্রকল্পটির ব্যয় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। 

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা পাটবীজের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারি না। আমরা পাটবীজের উৎপাদন বাড়াব। পাটের উৎপাদন বাড়াব। পাট চাষকে এ দেশের চাষিদের কাছে লাভজনক ফসলে উন্নীত করব। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য পাটের অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা  আবার ফিরিয়ে আনব।

সর্বশেষ খবর