বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘূর্ণিঝড়ে হালদায় মাছের ডিম ছাড়া নিয়ে শঙ্কা

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ডিমগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু নদীতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও জোয়ারের প্রভাবে বেড়েছে লবণাক্ত পানি। তাই মা মাছ ডিম ছাড়ার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, হালদা নদীর পানিতে সাধারণত লবণাক্ততার হার শূন্য দশমিক ৫ পয়েন্ট। কিন্তু এখন এ নদীর পানিতে লবণাক্ততার হার ৩ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে পৌঁছেছে। নদীর পানিতে লবণাক্ততার হার অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়েছে। এ কারণে চলতি প্রজনন মৌসুমে মা মাছের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত তিন দিন ধরেই বঙ্গোপসাগারে অবস্থান করছে প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। ফলে বৈরী আচরণ করছে প্রকৃতি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পূর্ণিমার জোয়ারের বর্ধিত পানি।

 গত সোমবার থেকে নদীতে লবণাক্ত পানি বাড়তে শুরু করে। ইতিমধ্যে কখনো মাঝারি, কখনো ভারি বর্ষণ হয়েছে। সাগরে পানির উচ্চতা বাড়ায় বেড়েছে জোয়ারের পানি। প্রবল জোয়ারে বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি কর্ণফুলী নদী হয়ে হালদায় প্রবেশ করেছে। নদীতে বৃদ্ধি পেয়েছে লবণাক্ততা। এতে মা মাছের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতকাল সকালে হালদা নদীর একাধিক পয়েন্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ইয়াসের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি কর্ণফুলী হয়ে হালদা নদীতে প্রবেশ করে। ফলে হালদার পানিতে লবণাক্ততা প্রায় ২০ গুণ বেড়েছে। এটি মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য প্রতিকূল পরিবেশ। এর বিরূপ প্রভাবও পড়তে পারে। লবণাক্ত পানিতে মা মাছ ডিম ছাড়া নিয়ে সংশয়ও থাকতে পারে। এ সমস্যা নিরসনে প্রয়োজন প্রবল বৃষ্টি, বৃষ্টিতে পাহাড়ি পানির ঢল এবং হালদা নদী থেকে কোনো প্রকারের পানি উত্তোলন না করা। অন্যথায় মা মাছ হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। পূর্ণিমা ও অমাবস্যা তিথিই ডিম ছাড়ার উপযুক্ত সময়। এসব তিথিতে বজ্রসহ প্রবল বর্ষণের ফলে নদীতে ঢলের সৃষ্টি হয়ে থাকে। নদীর উজান অংশ পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে প্রবল বর্ষণের ফলে নদীর সঙ্গে যুক্ত ছড়া ও শাখা খালের মাধ্যমে পাহাড়ি ঢল হালদা নদীতে এসে পড়ে। তখন ঢলের সময় মা মাছ ডিম ছেড়ে থাকে। চলতি মৌসুমে গত এপ্রিল থেকে তিনটি তিথি (জো) চলে যায়। তবে মা মাছ ডিম ছাড়েনি। তবে গত সোমবার ও মঙ্গলবার বৃষ্টির পর মা মাছ ডিম ছাড়তে শুরু করে। তাছাড়া গত সোমবার থেকে শুরু হয়েছে পূর্ণিমার জো। আগামী ২৮ মে পর্যন্ত থাকবে এ জো’র প্রভাব। গত মঙ্গলবার রাতে হালদা নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনা ও সত্তার ঘাটসহ আশপাশের অংশে কয়েক শত নৌকার মাধ্যমে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম আহরণ শুরু করেছে। তবে গড়দুয়ারা, নয়াহাট ও সিপাহি ঘাটে নমুনা ডিম বেশি পাওয়া গেছে বলে জানা যায়।

গড়দুয়ারার ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মা মাছ ডিম ছাড়ে। আমিও ২০০ গ্রামের মত ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছি। অন্য ডিম সংগ্রহকারীরাও ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। প্রতি বছরই গ্রীষ্ম মৌসুমে হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখেন। এ বছরও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় এক হাজার জন ডিম সংগ্রহকারী প্রস্তুতি নিয়েছেন।

অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, কিছু মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছে। কিন্তু কী পরিমাণ নমুনা ডিম ছেড়েছে তা এই মুহূর্তে নির্ণয় করা যায় না। তবে ডিম সংগ্রহ করতে সংগ্রহকারীরা অপেক্ষায় আছেন। আমরা এখনো মা মাছের ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় আছি। বৃষ্টি হলেই মা মাছ ডিম ছাড়বে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, গত এক মাস ধরে ডিম সংগ্রহকারীরা বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিলেন। গত দুই দিনে বিরতিতে বৃষ্টি হলে মা মাছ নমুনা ডিম ছাড়ে।

জেলা মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২২ মে হালদা নদী থেকে ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এটি ছিল একটি রেকর্ড। এর আগে ২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। তবে ২০১৬ সালে মাছ পুরোমাত্রায় ডিম ছাড়েনি। মাত্র ৭৩৫ কেজি নমুনা ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৬২৪ কেজি ও ২০১২ সালে ১ হাজার ৬০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর