শিরোনাম
শনিবার, ১০ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ

দিশাহারা শিল্পী কলাকুশলীরা

মোস্তফা মতিহার

আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পারমাণবিক বোমা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের হুমকি নয়, বিশ্ব মানবের জন্য বর্তমানে একমাত্র হুমকি ও আতঙ্ক করোনাভাইরাস। বৈশ্বিক এই দুর্যোগের প্রভাবে দেশের অন্য সব সেক্টরের মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনও স্থবির। বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিষাক্ত ২০২০-এর মতো আলোকিত সেই মঞ্চগুলো ২০২১ সালেও ঘোর অন্ধকার। কর্মহীন হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীরা। আর্থিক দৈন্যতার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন চলচ্চিত্র, টিভিনাটক, মঞ্চনাটক, সংগীত ও যাত্রার শিল্পীরা। এর প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অসচ্ছল ও নিম্নআয়ের মানুষ। বিশেষ করে এই অঙ্গনে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা কলাকুশলীদের যাপিত জীবনে নেমে এসেছে শনির দশা। টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রসহ সব ধরনের শুটিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করা মেকআপ আর্টিস্ট, ড্রেসম্যান, লাইটম্যান, প্রোডাকশন্স বয়, প্রোডাকশন্স ম্যানেজার, কোরিওগ্রাফার, ফাইট ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যান, সহকারী পরিচালক, ভিডিও এডিটর, ট্রলি বয়, ক্যামেরা ক্রু, যন্ত্রশিল্পী, এক্সট্রা তথা জুনিয়র আর্টিস্ট, আইটেম গার্ল, মঞ্চব্যবস্থাপক, সেট ডিজাইনারসহ সবার যাপিত জীবনেই বর্তমানে বিরাজ করছে রাজ্যের হতাশা। আর দীর্ঘদিন ধরে সিনেমা হলগুলো বন্ধ থাকার কারণে এর সঙ্গে জড়িত টিকিট মাস্টার, লাইনম্যান, মেশিন অপারেটরসহ প্রত্যেকেই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পরিবার-পরিজন ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা নিম্নআয়ের এসব কলাকুশলীরা।

নাট্যজন ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, সব কিছুর আগে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে ভ্যাকসিনই আমাদের বড় প্রয়োজন। চিকিৎসক, নার্স ও গণমাধ্যমকর্মীরা যেভাবে বিশেষ ক্যাটাগরিতে ভ্যাকসিন গ্রহণ  করতে পারেন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবাই যেন সেই ধরনের বিশেষ ক্যাটাগরির মাধ্যমে ভ্যাকসিন পান সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তথ্যমন্ত্রী আমাদের আশ্বাসও দিয়েছেন। এ ছাড়া গতবার সরকার যেভাবে প্রণোদনা দিয়েছিল এবারও সেই রকম প্রণোদনা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে সংকট কিছুটা হলেও কেটে উঠবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

অভিনেত্রী ও নির্দেশক লাকী ইনাম বলেন, পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়েও মারাত্মক। এই সময়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য। তবে বেঁচে থাকতে গেলে অবশ্যই মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। কাজ না থাকায় শিল্পীদের যাপিত জীবনে এখন গ্রহণের কাল। সরকার যদি এখনই এগিয়ে না আসে তাহলে দুস্থ শিল্পী ও কলাকুশলীদের জীবনে আরও বিপর্যয় নেমে আসবে। শিল্পীরা ভালো না থাকলে দেশ কীভাবে ভালো থাকবে।

মোমেনা চৌধুরী বলেন, সারা বিশ্ব যখন অনাচারে ভরে গেছে, নারীর প্রতি যখন সহিংসতা চরমে তখনই এই করোনা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ এসেছে। মানুষ যখন তার পাপের সীমা লঙ্ঘন করে তখন সৃষ্টিকর্তা তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। এই পরিস্থিতি আমরা খুব শিগগিরই কাটিয়ে উঠব বলেই আমি আশা রাখি।

বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. বিশ্বজিৎ রায় বলেন, দিনে দিনে করোনার চোখ রাঙানি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে বেঁচে থাকাটাই এখন মুখ্য বিষয়। বর্তমান সরকার শিল্পীদের দুরবস্থায় সব সময় সহযোগিতার হাত নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। প্রথম লকডাউনে যেভাবে সরকার সহযোগিতা করেছিল এবারের লকডাউনেও সেভাবে এগিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। লকডাউন চললেও বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের পক্ষে আমরা নিয়মিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছি।

চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহীন সুমন বলেন, সরকার কিছুদিন আগে আমাদের জন্য শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেছে। সে জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে সরকারেরই বা কী করণীয়? আমাদের বিভিন্ন সমিতি অতি গোপনে সামর্থ্য অনুযায়ী অসচ্ছল শিল্পী ও কলাকুশলীদের সাহায্য করে যাচ্ছি। প্রতিশ্রুতিশীল চিত্রনায়ক কায়েস আরজু বলেন, এই দুঃসময়ের মধ্যেও বর্তমান সংস্কৃতিবান্ধব সরকার আমাদের জন্য শিল্পী কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছে।

নানা দুঃসংবাদের মধ্যে এই সুসংবাদটি আমাদের চলার পথকে আরও মসৃণ করে দেবে বলে আমি আশা করছি। পরিস্থিতি যেটা চলছে তাতে কারওরই কিছু করার নেই। হয়তো আঁধার কেটে গিয়ে আবারও আলো ফুটে উঠবে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে করোনা পরিস্থিতির পর সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে আমাদের এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনার কারণে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে প্রথম লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এর আগেই গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত তাদের ৫টি মিলনায়তনের বরাদ্দ বাতিল করে শিল্পকলা অ্যাকাডেমি। এ ছাড়া নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪টি সংগঠন সম্মিলিত বৈঠকে গত বছরের ২২ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব ধরনের শুটিং বন্ধ ঘোষণা করে। এর পরে প্রথম ঢেউয়ের প্রথম লকডাউন শেষে করোনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গত বছরের ২৮ আগস্ট মোমেনা চৌধুরীর একক নাটক ‘লাল জমিন’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে নাট্যাঙ্গন নতুন করে তাদের পথচলা শুরু করে। নাটক সরণিখ্যাত বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ওই নাটকটি মঞ্চায়নের পর অন্য থিয়েটারগুলোও নাটক নিয়ে নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। এরই ধারাবহিকতায় ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের দাবির মুখে গত বছরের ২৩ অক্টোবর থেকে ছুটির দিনে নাটক মঞ্চায়ন ও অনুষ্ঠান আয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চগুলোও খুলে দেওয়া হয়। প্রথম ঢেউয়ের পর টিভিনাটক ও চলচ্চিত্রাঙ্গনেও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এ বছর দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিতে আঘাত হানার কারণে বর্তমানে দ্বিতীয় লকডাউনে আবারও স্থবির সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর