সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে

আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টা ও সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব, কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে দেড় টাকা, খামারিদের মাথায় হাত

মাহমুদ আজহার

পোলট্রি খাদ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে

ময়মনসিংহের আকুয়া বাইপাস এলাকার মুরগির ক্ষুদ্র খামারি মনিরুজ্জামান মনির। সেখানে তিনি একটি খামারে ১ হাজার বাচ্চা লালনপালন করেন। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে পোলট্রি ফিডের দাম বাড়ায় খামার বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বললেন, ‘গত সপ্তাহে ৫০ কেজি ওজনের মুরগির খাদ্য কিনেছেন ২ হাজার ৪০২ টাকায়। এখন কিনছেন ২ হাজার ৪৭৫ টাকায়। সপ্তাহ যেতে না যেতেই এভাবে দাম বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী মুরগি বা ডিমের দাম বাড়ছে না। এখন কী করব বুঝতে পারছি না।’

রবিউল ইসলাম নামে আরেক খামারি সম্প্রতি তার ফেসবুক পেজে লেখেন : ‘প্রতি কেজি খাদ্যের দাম এক থেকে দেড় টাকা বেড়েছে। আর মুরগির বাচ্চার দাম কমছে। এ অবস্থায় বাচ্চা তুলে নদীতে সাঁতার দিতে হবে।’

শুধু মনির বা রবিউলই নন, তাদের মতো কয়েক লাখ মুরগি খামারির মাথায় হাত। আন্তর্জাতিক বাজারে পোলট্রি খাদ্যের দাম প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সয়াবিন, ভুট্টাসহ কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়াই ফিডের দাম বেড়েছে। আবার দেশি ফিড সিন্ডিকেটও দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী। সে তুলনায় মুরগির দাম কম। অনেক খামারিই এখন মুরগি পালন বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকেই ভিন্ন কিছু করার কথা ভাবছেন।

এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও ভুট্টার দাম বেড়েছে। তা ছাড়া করোনায় দেশের বাইরে থেকে পোলট্রি খাদ্য আমদানিতে পরিবহন খরচ বাড়ছে। দেশেও ভুট্টা চাষ কম হচ্ছে। এসব কারণেই পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েই চলেছে। অবশ্যই খামারিদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সিন্ডিকেট করে খাদ্যমূল্য যেন না বাড়ানো হয় সে ব্যাপারে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ মুহূর্তে দেশি কাঁচামাল দিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করা দরকার। তা ছাড়া খামারিরা যেন মুরগি ও ডিমের ন্যায্য মূল্য পান সে ব্যাপারেও তদারকি বাড়াতে হবে।’

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাবে, ২০২০ সালের লকডাউনে দেশে ৩০-৩৫ শতাংশ পোলট্রি ফার্ম বন্ধ হয়ে যায়। করোনায় সব মিলিয়ে এ খাতে ক্ষতি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্রিডার্স ইন্ডাস্ট্রি খাতে ৪৫৮ কোটি, ফিড শিল্পে ৭৫ কোটি, বাণিজ্যিক পোলট্রি (ডিম ও মাংস) খাতে ৫০৩ কোটি, প্রসেসড ইন্ডাস্ট্রিতে ৩১ কোটি ও ওষুধ মিনারেল প্রিমিক্সসহ অন্যান্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) নেতারা জানান, করোনায় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমনিতেই উৎপাদনমূল্য পাচ্ছেন না তারা। এর মধ্যে পোলট্রি ফিডের দাম বস্তাপ্রতি ৭৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যদিও ভুট্টার মৌসুমে ফিডের দাম বাড়া অযৌক্তিক। চিঠিতে ফিডের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবি জানানো হয়।

এদিকে পোলট্রি ও মাছের খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ ও ফিড তৈরির উপকরণ রপ্তানি বন্ধের দাবিতে ২২ আগস্ট বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দিয়েছে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ। চিঠিতে তারা জানায়, মাছ, মুরগির মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনে মোট ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। ফিডমিল ও প্রাণিখাদ্য উৎপাদনে ৭০-৭৫ ভাগ ব্যয় হয় কাঁচামাল সংগ্রহে। ভুট্টা, সয়াবিন মিল, চালের কুঁড়া, আটা, ময়দা, সরিষার খইল, তেল, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল।

এর অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সয়াবিন মিল পোলট্রি ও মাছের খাদ্যের প্রধান উপাদান। বর্তমানে চাহিদাকৃত সয়াবিন মিল দেশি সয়াবিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানি সয়াবিন মিলের মোট চাহিদা বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন।

সংগঠনটি জানায়, এর মধ্যে অর্ধেক স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়। বাকিগুলো আমদানি করতে হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন মিলের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদিত সয়াবিন মিলের মূল্য ক্রমাগত বাড়িয়ে চলছে। অতীতে ভারত থেকে সয়াবিন আমদানি করা হলেও বর্তমানে সেখানেও দাম বেড়েছে। তাই আমেরিকা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে কিছু কিছু সয়াবিন আমদানি হচ্ছে। স্থানীয় সয়াবিন মিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাই সয়াবিন মিল, ভুট্টাসহ প্রতিটি কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ফিডের দামও বেড়েই চলেছে।

পোলট্রি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় ১ হাজার ২০০ মুরগির খামার রয়েছে। এর অনেকেই মুরগি পালন বন্ধ করে দিয়েছেন। গতকাল এ সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল বলেন, ‘ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যত না বেড়েছে তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের দেশি সিন্ডিকেট। এই শ্রেণির কারণে পোলট্রি ফিডের দাম হু হু করে বাড়ছে। তাদের দৌরাত্ম্য থামাতে হবে। সরকারকে খামারিদের স্বার্থে ফিডের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। নইলে পোলট্রিশিল্প পুরোপুরি ধ্বংসের মুখোমুখি হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর