শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

পিপিপি ধারণা থেকে সরে আসছে সরকার

প্রত্যাহার করা হচ্ছে একের পর এক প্রকল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালের পর বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) নিয়ে। আর এখন পিপিপি নিয়ে সরকারের মধ্যে বিরাজ করছে চরম হতাশা। গত ১১ বছরে পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র একটি প্রকল্প। ফলে অবকাঠামো খাত ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে পিপিপি ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে সরকার। চলতি বছর অন্তত তিনটি প্রকল্প পিপিপি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব প্রকল্প এখন বাস্তবায়ন করা হবে সরকারি উদ্যোগে। শুরুর দিকে পিপিপি নিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা দিলেও এখন তা তলানিতে নেমে এসেছে। ফলে পিপিপি আইনেও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। সর্বশেষ গত মাসের শেষ দিকে ‘মাতারবাড়ী-বাঁশখালী-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন’ প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিলে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এদিকে পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবকাঠামো চাহিদা পূরণে দেশি উৎস থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ১৪ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন পিপিপি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর ছয় বছর পর দু-একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড (বিআইএফএফ)। জামানত সংকটসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন থেকে বিরত থাকছে, যা পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানান পিপিপি কর্তৃপক্ষ। এরপর অর্থায়ন সংকট কাটাতে আশানুরূপ সমাধান হয়নি। ফলে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে পিপিপি-নির্ভরতা কমিয়ে আনছে সরকার।

পিপিপি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণের বিপরীতে জামানত একটি সর্বজনীন বিষয়। তবে এটি আইন দ্বারা সিদ্ধ নয়। কিন্তু দেশি ব্যাংকগুলো জামানত ছাড়া ঋণ দিতেও অভ্যস্ত নয়। ফলে এসব ব্যাংক প্রজেক্ট ফাইন্যান্স পদ্ধতিতে ক্যাশ ফ্লোর ওপর নির্ভর করে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখায়। পিপিপি প্রকল্পে সরকারি জমি জামানত হিসেবে যে বন্ধক রাখা সম্ভব নয়, এ ক্ষেত্রে ব্যাংকাররা বিষয়টি মানতে চান না। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের বিপরীতে শেয়ারহোল্ডারদের ব্যক্তিগত সম্পদের গ্যারান্টি চাওয়া হয়, যা প্রচলিত প্রকল্প অর্থায়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ কারণে পিপিপি থেকে প্রকল্প প্রত্যাহারে বাধ্য হচ্ছে সরকার, এমনটাই মনে করেন পিপিপি কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পিপিপি অথরিটির সচিব ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা আফরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকল্পগুলো শেষ করা যায়। করোনার কারণে গত বছর কাজের গতি কিছুটা কম ছিল। কিন্তু এখন আমরা গতি বাড়িয়েছি। আপনি জানেন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ এ মুহুর্তে যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতের বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ হচ্ছে পিপিপির অধীনে। আগামী বছরের মাঝামাঝি এ প্রকল্পের প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে মহাখালী পর্যন্ত যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এতে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে আসবে।’ এ ছাড়া বাস্তবায়নাধীন মোংলা বন্দরের প্রকল্পটিও আগামী বছরের জুনেই শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও সহযোগিতা ছাড়া যে কোনো ধরনের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলকে ইন্টারনেটের আওতায় আনতে ও গতি বাড়াতেও পিপিপির অধীন বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণেরও অংশ বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়নের নতুন ধারণা নিয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) অধীন কাজ শুরু করে বর্তমান সরকার। ২০১০ সালে এসে এ-সংক্রান্ত একটি কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে পিপিপি কর্তৃপক্ষের যাত্রা হয়। প্রথম দিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে পিপিপি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হলেও সময়ের ব্যবধানে তা এগিয়েছে কচ্ছপ গতিতে। ফলে গত ১১ বছরে পিপিপির অধীন শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে একটিমাত্র প্রকল্প। এ মুহুর্তে আরও ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ‘কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার’ শীর্ষক প্রকল্পটি ন্যাশনাল কিডনি হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের উপস্থাপিত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতার তথ্যানুযায়ী আগামী বছরের (২০২২) জুনের মধ্যে পিপিপির অধীন ৮৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর পিপিপি কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বিভিন্ন মেয়াদে পিপিপির অধীন ৭৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এ তালিকার আটটি প্রকল্প বাদে বাকি প্রায় সবই কার্যাদেশ দেওয়া, চুক্তি, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর পর্যায়ে রয়েছে, যা মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ৮৮টি প্রকল্প পিপিপির অধীন কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এর কোনো ব্যাখ্যাও নেই প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে।

সর্বশেষ খবর