বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

১০ বছরে গায়েব ৩৬ হাজার কোটি টাকা

এমএলএম, ব্যাংকের ঋণ, রিজার্ভ চুরি ও ই-কমার্স প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্ত সরকার ও সাধারণ মানুষ

মাহবুব মমতাজী

দেশে গত ১০ বছরে কয়েকটি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ৩৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এমএলএম, ব্যাংকের ঋণ, রিজার্ভ চুরি ও ই-কমার্স প্রতারণায় এ টাকা খোয়া গেছে। এসব আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকার এবং বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। তবে, সাজা পাননি অভিযুক্তদের কেউ। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। অভিযুক্তদের কেউ জেলে, কেউ বিদেশে।  এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মনে করেন, সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে সাধারণদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সালের সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিতে অর্থ আত্মসাৎ হয় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয় আরও প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনির অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের কারও সাজা হয়নি। হল-মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম কারাগারে রয়েছেন। ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনও কারাগারে। এ ছাড়া দেশের বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির মধ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা। ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চুরি করা হয় ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। স্বয়ংক্রিয় লেনদেন ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ বা হ্যাক করে এই রিজার্ভ চুরির ঘটনা এখনো বিশ্বজুড়ে অন্যতম আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করছে সিআইডি।  তবে সিআইডিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন দেশের কাছ থেকে তথ্য না পাওয়ায় রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে পারছে না সংস্থাটি। এদিকে এমএলএম কোম্পানির নামে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে পিরোজপুরের রাগীব আহসানের মালিকানাধীন এহসান গ্রুপ।

গত ৯ সেপেটম্বর রাতে রাজধানীর তোপখানা রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাগীব আহসান ও তার সহযোগী আবুল বাশার খানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গত দুই বছরে ই-কমার্সের নামে অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি সূত্র। তবে সংস্থাটিতে বিভিন্ন ই-কমার্সের নামের বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্নস্থানে করা ২৯টি মামলার তদন্তভার রয়েছে। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইমাম হোসেন বলেন, প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা পুলিশের নেই। আমরা তদন্ত সংস্থা, তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়ে দেই। আর বাকিটা আদালত কিংবা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে ই-কমার্স সম্ভাবনাময়। গুটি কিছু লোকের জন্য এই খাতের দুর্নাম হচ্ছে।

 

২০০৪ সালে ডেসটিনির অন্য গ্রাহকদের প্ররোচনায় পড়ে ৬ হাজার টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ট্রি প্ল্যানটেশনের একটি প্যাকেজ কিনেন সাধারণ খেটে খাওয়া দিনাজপুরের জহুরা বেগম নামে ৫০ বছর বয়সী এক নারী। ২০১২ সালে লভ্যাংশসহ তার টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে আরও ৯ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তার কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পাননি। জহুরা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মুই এলাও কহিবা পারেছু না, টাকা মোক ফেরত দিবে না নাই, কোনদিন কি টাকা ফেরত পাম?’

সিআইডি সূত্র বলছে, ইভ্যালির বিরুদ্ধে গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশান থানায়, ১৭ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি থানায় এবং ৩০ সেপ্টেম্বর বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে। তিনটি মামলাই সিআইডিতে তদন্তাধীন।

এদিকে, রিং আইডির বিরুদ্ধে গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ভাটারা থানায় এবং একই দিন যশোর কোতোয়ালি থানায় আরেকটি মামলা হয়। ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গত ১৭ আগস্ট, ২, ৭, ১৩, ২১ এবং ২৪ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় পৃথক ছয়টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত ১ অক্টোবর রমনা থানায় আরেকটি মামলা হয়। ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে গাজীপুরের টঙ্গী, রাজধানীর বনানী ও হাজারীবাগ থানায় যথাক্রমে ২৩ সেপ্টেম্বর, ৯ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর তিনটি মামলা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ শপের বিরুদ্ধে বনানী থানায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর একটি মামলা হয়। এ ছাড়া এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে পিরোজপুর সদর থানায় ৯, ১০, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর মোট পাঁচটি মামলা হয়। সহজ লাইফ অ্যান্ড লাইভলি লাইফের বিরুদ্ধে গাজীপুরের কাশিমপুর থানায় গত ২১ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর দুটি মামলা হয়েছে। এদিকে এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধে গত ২৬ আগস্ট রাজধানীর কলাবাগান থানায় এবং ২৮ সেপ্টেম্বর যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে। টুয়েন্টিফোর টিকেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় গত ১৭ জুলাই এবং গত ৩ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপদ শপের বিরুদ্ধে গত ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় একটি মামলা হয়েছে। সবগুলো মামলাই সিআইডিতে তদন্তাধীন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যদি প্রতারিত হওয়া ভুক্তভোগীদের আইনজীবীদের তৎপরতা না থাকে তাহলে মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা থাকবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকেও ভূমিকা রাখতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর