সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

ইউএনওদের জন্য ৫০ স্পোর্টস জিপ কিনবে সরকার

রেকর্ড ৭৪০৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি দরপ্রস্তাব অনুমোদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

রেকর্ড ৭৪ হাজার ৮১ কোটি টাকার আটটি দরপ্রস্তাব অনুমোদন করেছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। চলতি অর্থবছরের কোনো বৈঠকে এত বেশি পরিমাণ ব্যয়ের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়নি। অনুমোদিত দরপ্রস্তাবগুলোর বেশির ভাগই বিদ্যুৎ খাতের। আগামী পাঁচ বছরে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও ভারত থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিতে আগামী ২২ বছরে খরচ হবে ৬৯ হাজার কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তির নবায়ন ও নতুন ট্যারিফ অনুমোদন করেছে ক্রয় কমিটি। নতুন চুক্তি অনুযায়ী ট্যারিফ হবে প্রথম বছর প্রতি কিলোওয়াট ৬ দশমিক ২৭ রুপি যা বাংলাদেশি টাকায় ৭ দশমিক ১৩ টাকা। আবার পরের বছর থেকে এই রেট ২ শতাংশ হারে বাড়বে। বিদ্যমান রেটে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। গড়ে মূল্য ছিল পার কিলোওয়াট রুপিতে ৬ দশমিক ৬৮ রুপি, যা বাংলাদেশি টাকায় ৭ দশমিক ৬১ টাকা। গতকাল ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শামসুল আরেফিন এ বিষয়ে ব্রিফিং করেন। এদিকে একই স্থানে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) ব্যবহারের জন্য ৫০টি স্পোর্টস জিপ কেনার দরপ্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১৩ কোটি ৮২ লাখ লোককে টিকাদানের লক্ষ্যে ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য ২৭ কোটি ৬৪ লাখ সিরিঞ্জ কেনার প্রস্তাবেও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয় গতকাল। উভয় সভায় সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শামসুল আরেফিন জানান, বৈঠকে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার মেঘনাঘাট জামালদিতে ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাস বা আরএলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘এডরা পাওয়ার হোল্ডিং এসডিএন বিএইচডি’ এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান ‘উইনিভিশন পাওয়ার লিমিটেড’-এর সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২২ বছর মেয়াদে বিদ্যুৎ কিনবে সরকার। এই ২২ বছরে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৬৯ হাজার ১৬৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। তিনি জানান, বৈঠকে ভারতের ত্রিপুরার ‘এনটিপিসি ভিডজাট ভায়াপার নিগাম’ (এনভিভিএন) থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর বৃদ্ধি এবং বর্ধিত মেয়াদের জন্য ট্যারিফ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের ট্যারিফ হার ৭ দশমিক ১৩৮৫২ টাকা হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদে ব্যয় হবে প্রায় ৪ হাজার ১৮৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ত্রিপুরার এনভিভিএন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে বিদ্যুৎ আমদানির বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ চলতি বছরের গত ১৬ মার্চ শেষ হয়েছে।

অতিরিক্ত সচিব জানান, বৈঠকে করোনা পরীক্ষার জন্য ২০ লাখ ‘আরটি-কিউপিসিআর ডায়াগনস্টিক কিট’ (ভিটিএম ও সোয়াবসহ) ক্রয়ের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো (সিএমএসডি) এগুলো ক্রয় করবে। তিনটি লটে তিনটি প্রতিষ্ঠান- ‘স্টেরলিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেড’, ‘ওএমসি (প্রাইভেট) লিমিটেড’ ও ‘জিএস বায়োটেক’ এসব কিট সরবরাহ করবে। এতে ব্যয় হবে ১১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

তিনি জানান, বৈঠকে ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ প্রকল্প’-এর আওতায় ৭০ টনের দুটি বোলার্ড পুল টাগবোট এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সেবা ক্রয়ের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ‘খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড’ থেকে এগুলো সরবরাহ করা হবে। ব্যয় হবে ১৩১ কোটি ৭৩ লাখ ৪১ হাজার ৮৯৬ টাকা। অতিরিক্ত সচিব জানান, বৈঠকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন করে ৯০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ক্রয়ের পৃথক তিনটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সরকারের কাউন্টার গ্যারান্টির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ‘বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন’ (বিসিআইসি) এসব সার ক্রয় করবে। এর মধ্যে প্রতি মেট্রিক টন ৬০১ ডলার হিসেবে ‘কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড’ (কাফকো) থেকে ৬ষ্ঠ লটে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ব্যাগড গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার ক্রয়ে ব্যয় হবে ১৫৪ কোটি ২৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা; রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে কাতার-এর ‘মুনতাজাত’ থেকে প্রতি মেট্রিক টন ৬১৫ ডলার দরে ৬ষ্ঠ লটে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার আমদানিতে ব্যয় হবে ১৫৭ কোটি ৮৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং একই দরে সৌদি আরবের ‘সৌদি বেসিক ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন’ থেকে ৭ম লটে ৩০ হাজার মেট্রিক টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার আমদানিতে ব্যয় হবে ১৫৭ কোটি ৮৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।

তিনি জানান, বৈঠকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক স্তরের (৩য়,  ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি) বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৫ কপি বই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি লটে তিনটি সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান এসব বই সরবরাহ করবে। প্রতিষ্ঠান তিনটি হচ্ছে- ‘প্রেস লাইন লিমিটেড’ (২টি লট); ‘লেটার এন কালার’ (২টি লট) ও ‘সেডনা প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স’। এতে ব্যয় হবে ৮ কোটি ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৩০ টাকা।

ইউএনওদের জন্য ৫০ জিপ : মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সামসুল আরেফিন এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ‘প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ থেকে ৫০টি মিৎসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস কিউএক্স জিপ কেনা হবে। পুরাতন জিপগুলোর আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় মেরামত করে সেগুলো প্রশাসনিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিস্থাপক হিসেবে গাড়িগুলো উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সময়সাপেক্ষ হওয়ায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, বৈঠকে আরও দুটি প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে- কভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে টিকাদানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ক্রয়ের নীতিগত অনুমোদন। তিনি বলেন, কভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১৩ কোটি ৮২ লাখ লোককে টিকাদানের লক্ষ্যে ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন প্রদানের জন্য ২৭ কোটি ৬৪ লাখ সিরিঞ্জ প্রয়োজন। প্রতি মাসে ২ কোটি মানুষকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যে ৯ কোটি ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ জরুরি ভিত্তিতে ক্রয় করতে হবে। রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ৯ কোটি এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ‘চায়না ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যালস ফরেন ট্রেড করপোরেশন’ থেকে ক্রয়ের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, বৈঠকে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপিভিত্তিক নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাবটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের প্রস্তাব গত ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ‘অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র সভায় নীতিগত অনুমোদন-পরবর্তী সমীক্ষা পরিচালনা এবং বিশদ নকশা প্রণয়ন করা হয়। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ না করে বিদ্যমান চার লেনবিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রশস্তকরণ এবং উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি পিপিপি পদ্ধতিতে নির্মাণের কার্যক্রম বাতিলের প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর