বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

গ্রাহকের শত কোটি টাকা আত্মসাৎ

কর্ণফুলী মাল্টিপারপাসের এমডিসহ গ্রেফতার ১০

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতারণার মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাকিল আহমেদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মো. চাঁন মিয়া, এ কে আজাদ, মো. রেজাউল, মো. তাজুল ইসলাম, মো. শাহাবুদ্দিন খান, আবদুস ছাত্তার, মো. মাসুম বিল্লাহ, মো. টিটু মিয়া ও মো. আতিকুর রহমান। সোমবার বিকালে রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাব বলছে, প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহকের শত কোটির টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার জসিম উদ্দিন। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির চেয়ারম্যানের অন্যতম সহযোগী ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাকিল আহমেদসহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে সমিতির সভাপতি জসিমসহ সমিতির কার্যকরী কমিটির অন্য সদস্যদের পাওয়া যায়নি। জসিম উদ্দিন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অর্থ ট্রান্সফার করে অর্থ পাচার করেছেন। নামে-বেনামে কিনেছেন প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ গড়ে তুলেছেন আটটি প্রতিষ্ঠান। মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহসভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার, কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন, যুগ্ম সম্পাদক নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। একরকম পারিবারিক একটি সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত। সরকারি হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জন গ্রাহক উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ ও র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক শত কোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য অনুযায়ী, কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে ১ হাজার টাকা করে বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দেয়, তবে পাঁচ বছরে তার ৬০ হাজার টাকা জমা হবে। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আর সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম এক বছরে প্রতি মাসে ২০০ টাকা এবং পরবর্তী চার বছর প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে পাবেন। আবার কোনো সদস্য যদি নতুন কোনো সদস্যকে এক হাজার টাকার এফডিআর করাতে পারেন তাহলে তাকে মাসে ১ হাজার টাকা এবং এফডিআর করা সদস্যকে ২ হাজার টাকা দেওয়ার প্রলোভন দিত ।

পাঁচ বছরে ৫০ শতাংশ লভ্যাংশের ফাঁদ : গ্রেফতার শাকিল আহম্মেদ ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্পসময়ে অধিক মুনাফা দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে গার্মেন্টকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষ বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। তাদের তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফার প্রলোভন দেওয়া হতো। কিন্তু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হতো না। ডিপিএসের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না।

ধূর্ত জসিম সবসময়েই ছিলেন আড়ালে : মূল অভিযুক্ত পলাতক আসামি জসিম উদ্দিন মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। ২০০৩ সালে তিনি অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালে সমবায় অধিদফতর থেকে নিবন্ধন পায়। ২০১৮-১৯ সালে তাদের গ্রাহক সংখ্যা ৫১৮ জন। প্রকৃতপক্ষে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০-২৫ হাজার গ্রাহক সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রাহকের টাকায় জসিম গড়েছেন আট প্রতিষ্ঠান : কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ছাড়াও জসিম নিজের নামে-বেনামে আরও সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্ণফুলী রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, জসিম ইন্টান্যাশনাল ওভারসিস লিমিটেড, জসিম স্টুডেন্ট কনসাল্টেন্সি ফার্ম, জসিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, জসিম ওয়েলফার ফাউন্ডেশন, জসিম নিট কম্পোজিট লিমিটেড। এসব কোম্পানির নামে লেনদেন ও টাকা স্থানান্তর করলেও কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস ছাড়া বাকি সাত কোম্পানির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। গ্রাহকের টাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি ও জমি কিনেছেন।

সমবায় অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তা অডিট করেছিলেন তাদের জিজ্ঞাবাদ করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, ২০১৯-২০২০ সালে সমবায় অধিদফতর অডিট করে। অডিটে দেখানো হয় ৫১৮ জন সদস্য। আর লেনদেন দেখানো হয় মাত্র ৮২ লাখ টাকা। অথচ র‌্যাবের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে লেনদেন হয়েছে শত কোটির বেশি। বাকি টাকা মানি লন্ডারিং হয়েছে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন তাহলে সমবায় অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

সর্বশেষ খবর