শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বদলে গেছে পদ্মার গতিপথ জেগেছে অসংখ্য চর

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

বদলে গেছে পদ্মার গতিপথ জেগেছে অসংখ্য চর

পদ্মা শুকিয়ে জেগেছে চর। ছবিটি গতকাল বিকালে রাজশাহী নগরীর সাতবাড়িয়া এলাকা থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

আগের মতো পানি নেই পদ্মায়, স্রোতও নেই। প্রবাহ এখন তলানিতে। জেগে উঠেছে বড় বড় চর। শুষ্ক মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানি শূন্যতা। পরিবেশবিদদের মতে, পদ্মার এমন বদলে যাওয়া, প্রভাব ফেলছে উত্তরাঞ্চলের পরিবেশের ওপর।

পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার পানি প্রবাহ কমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। ফলে সেচনির্ভর চাষাবাদ ব্যাহত হয়। শাখা নদীগুলো ইতিমধ্যেই মরে গেছে। জেগে ওঠা জমি দখলে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা। দখলবাজরা গড়ে তুলেছেন নানা প্রতিষ্ঠান।  নদী গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘পদ্মা ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীতে চর জেগে ওঠে। আর বর্ষায় শুরুতে বাঁধ খুলে দেওয়ায় প্রচ- বেগে ধেয়ে আসা স্রোত আছড়ে পড়ে দু-কূলে। এজন্য প্রতিবছর নদী ভাঙনে হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। বর্ষাকালে পদ্মার পানিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের পুকুর, নদী-নালা ও খাল-বিল পানিতে ভরে যেত। ওই পানি দিয়ে ফসল উৎপাদন করা হতো। এ সময় পদ্মা তার শাখা নদীর মধ্য দিয়ে চলনবিলের মতো বড়বড় বিল পানিতে ভরিয়ে দিত। আবার শুষ্ক মৌসুম এলে বিলগুলো পদ্মাকে পানি দিত। তখন কি সুন্দর বিল আর নদীর পানির আদান-প্রদান ছিল। শাখা নদীগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় যেমন এখন আর বর্ষায় বিলে পানি যেতে পারে না, তেমনি বিল থেকেও পদ্মায় পানি আসে না। এর ফলে খরা মৌসুমে এ অঞ্চলে পানি সংকট লেগেই থাকে। সেচের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এজন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ দিয়ে ধান উৎপাদনে খরচ বেশি হচ্ছে। এর ফলে কৃষক ফসল উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এ অঞ্চল মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’ পদ্মা নদীতে এখন পিঁয়াজ ও ধানের চাষ করা হচ্ছে। পদ্মা নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

পদ্মার সেই খরস্রোত এখন নেই। বিস্তৃত পদ্মাজুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর। ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকে এ অঞ্চলে পদ্মার পানিতে টান পড়েছে। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর তিন থেকে ছয় ফুট পলি পড়ছে পদ্মায়। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানিতে আগের মতো স্রোত না থাকায় এসব পলি কাটছে না। ফলে ড্রেজিং করে নাব্য ফেরানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দীকি।  খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর থেকে সরে যাচ্ছে পদ্মার পানির গতিপথ। কারণ, নগরের তীরঘেঁষে চর জেগেছে। এ ছাড়া গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জ মোহনা থেকে প্রেমতলী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পদ্মা নদীর ৬০ ভাগ এলাকায় পানি নেই। ৪০ ভাগ এলাকায় পানি থাকলেও নদীর গভীরতা খুবই কম। নদীর মাঝপথে অসংখ্য ডুবোচর। একসময় পানিতে পরিপূর্ণ ছিল পদ্মা। পদ্মায় পানি ভরে থাকার কারণে নদী উত্তাল হয়ে থাকতো। আর এখন নদীর পানি কমে যাওয়ায় কৃষি জমিতে পানি পেতে বেগ পোহাতে হয়।  পদ্মাপাড়ের বাসিন্দা ৯০ বছরের বৃদ্ধ সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গিপুর থেকে নৌকা অথবা জাহাজে মালভর্তি করে সরাসরি গোদাগাড়ী উপজেলার রেলবাজার বন্দরে আসত। আবার রেলবাজার বন্দর থেকে মালামাল নিয়ে ভারতের উদ্দেশে নৌকা ও জাহাজগুলো রওনা হতো। কিন্তু নদীর পানি কমে যাওয়ায় নাব্যতা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে। নদীর এই দূরাবস্থার কারণে পাকিস্তান আমলে গোদাগাড়ীর রেলবাজার বন্দরটি বন্ধ হয়ে যায়।’

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘নদীর গতিপথ পরিবর্তনই হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য। সেদিক থেকে বলা যায়, নদী সবসময়ই তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এখন যেমন শহর থেকে নদীর গতিপথ সরে যাচ্ছে। শহরের পাশেই বড় বড় চর পড়ছে। তার ঠিক উল্টোটা ঘটছে নদীর ওই পাশে। নদীর ওই পাশে চর খানপুর ও চর খিদিরপুরে ভাঙন হচ্ছে। ভাঙতে ভাঙতে ওই পাশ বিলীনের পথে। ফলে পানির প্রবাহ ঠিক থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পানির প্রবাহ ঠিক না থাকলে এইরকম ভাঙা-গড়া চলতেই থাকবে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দূরাবস্থার সম্মুখীন হবো। এজন্য পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। আর এই হিসাবটাও করতে হবে পুরো গঙ্গা রিভার বেসিন অনুযায়ী। শুধু ফারাক্কা থেকে কত কিউসেক পানি আসছে, তার ওপর বিষয়টা নির্ভর করে না।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রকীব আহমদ জানান, এভাবে ড্রেজিং করে পদ্মায় নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারণ নদীর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা পরিবর্তনশীল। ড্রেজিং করার ফলে এক জায়গায় কিছুটা নাব্যতা হয়তো সাময়িক ফিরে আসবে, কিন্তু অন্য জায়গায় ভাঙন দেখা দেবে। ড্রেজিং শুধু টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই নয় বলে মনে করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর