বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

১০ বছর ধরে পর্নো বাণিজ্যের কথা স্বীকার, খালাস পেলেন সেই টিপু

মাহবুব মমতাজী

প্রায় ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেও খালাস পেয়েছেন এক ব্যক্তি। তার নাম টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া। একই সঙ্গে তার আরও তিন সহযোগীও খালাস পেয়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আদালতের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। তবে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে টিপু জানিয়েছিলেন, তিনি ২০০৫ সাল থেকে শিশুদের নগ্ন ছবি ধারণ ও ভিডিও করে আসছিলেন।

সিআইডিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইন্টারপোলের দেওয়া তথ্যে ২০১৪ সালের ৯ জুন সিআইডি কর্মকর্তাদের হাতে গ্রেফতার হন টিপু কিবরিয়া। তবে তিনি শিশুসাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী হিসেবেও পরিচিত। তিনি আন্তর্জাতিক শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্য। টিপু কিবরিয়া ও তার তিন সহযোগী পথশিশুদের নগ্ন ছবি টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাচার করে থাকেন। এর বিনিময়ে বিদেশ থেকে টাকা পান তারা। এ ঘটনায় সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক বাবুল ভূঁইয়া বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক শাহ আলম মিয়া। এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে টি আই এম ফকরুজ্জামান ওরফে টিপু কিবরিয়া, নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়া, নুরুল ইসলাম ও শাহারুল ইসলামকে। এরপর একই বছরের ৯ নভেম্বর আদালতে আরেকটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এখানে শুধু নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এদিকে আদালত সূত্র জানিয়েছে, এ মামলায় সাত পুলিশ সদস্য ও তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া নিরপেক্ষ আরও চারজন সাক্ষী দিয়েছেন। টিপু কিবরিয়া ও একই দিন গ্রেফতার নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। দুই দফায় চার দিন রিমান্ড শেষে ২০১৪ সালের ১৫ জুন টিপু কিবরিয়া ঢাকা মহানগর হাকিম অশোক কুমার দত্তের আদালতে জবানবন্দি দেন।

আগের দিন ঢাকা মহানগর হাকিম মেহের নিগার সূচনার আদালতে জবানবন্দি দেন শাহারুল ইসলাম। এ মামলায় পুলিশ এক পথশিশুকেও বিচারকের কাছে হাজির করে। কী করে এ চক্রের খপ্পরে পড়েছিল, সে সম্পর্কে শিশুটি বিস্তারিত বিবরণ দেয়। মামলার ছয় বছর পর গত বছর নভেম্বরে মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। তিনি আসামি টি আই এম ফকরুজ্জামাম ওরফে টিপু কিবরিয়া, নুরুল আমিন ওরফে নুরু মিয়া, নুরুল ইসলাম ও শাহারুল ইসলামকে খালাস দেন। কেন আসামিদের খালাস দিয়েছেন, সে সম্পর্কেও তিনি রায়ে উল্লেখ করেছেন।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন) এস এম আশরাফুল আলম এ প্রতিবেদককে জানান, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। আপিলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্নোগ্রাফি তৈরিতে যেসব ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার হয়েছিল, সেগুলোর ফরেনসিক করা হয়। সেসব তথ্য আদালতে দাখিল করা হয়েছিল।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাটি আমাদের কাছে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে ছিল। মামলায় তথ্য-প্রমাণের ক্ষেত্রে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, বিভিন্ন ফরেনসিক রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়েছে। এর পরও আদালত ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করে রায় দিয়েছেন। তবে আমরা মাস তিনেক আগে আপিল করার জন্য পাবলিক প্রসিকিউটর বরাবর আবেদন দিয়েছি।’

সূত্র জানায়, বিচারকের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে এক ভুক্তভোগী শিশু জানিয়েছিল, একদিন সে স্টেশনে বসে তাল খাচ্ছিল। এমন সময় একটা বুড়া লোক এসে তার সঙ্গে ভাব জমান। জানতে চান, সে ভাত খেতে চায় কি না। ভাত খাওয়ার জন্য পকেট থেকে ৩০ টাকা বের করে দিয়ে একটা চাকরিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। সেই বুড়া লোকটি ছিলেন নুরুল আমিন। শিশুটি নুরুলের হাত ধরে তার বাসায় যায়। কিন্তু বাসায় নিয়ে গেলে সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, সিআইডির তৎকালীন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আফতাব উদ্দীন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালান। ওই দিন বিকাল ৫টায় গোড়ান রেলক্রসিং এলাকায় তিনি টিপু কিবরিয়াকে গ্রেফতার করেন। তিনি পর্নোগ্রাফি তৈরি করার কথা স্বীকার করেন এবং জানান, তার বাসায় পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম আছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ টিপু কিবরিয়ার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে হার্ডডিস্ক ও কিছু যন্ত্রাংশ জব্দ করে। এই যন্ত্রাংশগুলো সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়। পুলিশ সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে চারজন নিরপেক্ষ সাক্ষী হাজির করে। এই সাক্ষীদের সবাই বলেছেন, তাদের কাছ থেকে পুলিশ সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। তারা কোনো জবানবন্দি দেননি। আসামিদের কাছ থেকে কী কী জিনিস উদ্ধার হয়েছে, সে ব্যাপারে তারা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি মামলাটি তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছেন। কিন্তু আসামি পক্ষের জেরায় তিনি বলেছেন, কোনো শিশু বা ভুক্তভোগী কারও তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। আসামিরা ইন্টারনেটে ছবি আপলোড করে বিদেশি ডলার আয় করতেন বলে তথ্য আছে চার্জশিটে। কিন্তু কোনো ব্যাংক হিসাব পাননি। এমনকি তদন্তের সময় এ মামলায় ভুক্তভোগী হিসেবে যে কিশোর বিচারকের কাছে বক্তব্য দিয়েছে, তাকেও আদালতে হাজির করা হয়নি। কোন কোন দেশে পাচার করা হয়েছিল, তা পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি।

তবে টিপু কিবরিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করে সেবা প্রকাশনীর কিশোর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে ১০ বছর চাকরি করেছেন। তার একটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ছিল। সেবা প্রকাশনীতে চাকরির সময় তার ৫০টি কিশোর উপন্যাস বের হয়। ২০০৩ সাল থেকে তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শুরু করেন। নুরুল আমিনের সঙ্গে তার পরিচয় ২০০০ সালে মুগদা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়ে। আলাপ-আলোচনায় তিনি বুঝতে পারেন, নুরুল ইসলাম অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে থাকেন। পরে এই নুরুল আমিনের সঙ্গে তিনি জোট বাঁধেন। ঢাকা শহরের কল্যাণপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসহ নানা জায়গা থেকে বাচ্চাদের ছবি তোলার কাজের কথা বলে নিয়ে আসতেন নুরুল। নুরুলকে নিয়ে টিপু কিবরিয়া শিশুদের ছবি তুলতেন এবং ভিডিও ফুটেজ তৈরি করতেন। তিনি নিয়মিত ইন্টারনেটে ওই সব ছবি ও ভিডিও আপলোডও করতেন। একটা সময় কয়েকজন বিদেশি তাকে শিশুদের নগ্ন ছবি পাঠাতে বলেন। বিনিময়ে তারা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা পাঠাতেন। ওই সব টাকা অথবা কারেন্সি তিনি মৌচাক, উত্তরা, মতিঝিলের ব্র্যাক ব্যাংকের মাধ্যমে তুলেছেন। ২০০৫ সাল থেকে তিনি এভাবে নগ্ন ভিডিও করে আসছিলেন। তার মক্কেলরা জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিক। যাদের কাছে তিনি এসব ছবি ও ভিডিও পাঠাতেন, তাদের ই-মেইল ঠিকানাও তার কম্পিউটারে আছে। প্রতি মাসে এ কাজ করে টিপু কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা পেতেন। ওই টাকা দিয়ে তিনি নিজে চলতেন, আর প্রতি সপ্তাহে নুরুল ইসলাম ও নুরুল আমিনদের ২ হাজার টাকা করে দিতেন। যে ছেলেদের যৌন নির্যাতন করা হতো, তাদের দিতেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।

সিআইডি সূত্র বলছে, টিপু কিবরিয়া তার তৈরি পর্নোগ্রাফি ১৩টি দেশের ১৩ নাগরিকের কাছে পাঠাতেন। এসব দেশের মধ্যে আছে কানাডা, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মধ্য ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর