শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সংস্কৃতির রঙে রঙিন বিজয় দিবস

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

সংস্কৃতির রঙে রঙিন বিজয় দিবস

গতকাল ১৬ ডিসেম্বর ছিল ৫০তম বিজয় দিবস। দিবসটি উদযাপনে গোটা জাতি ভেসেছিল বাঁধভাঙা আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উল্লাস আর মুক্তির উন্মাদনায়। লাল-সবুজের পোশাকে নিজেদের আবৃত করে স্বদেশের প্রতি প্রকাশ করেছে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছিল আনন্দের বাঁধভাঙা ঢেউ। ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাশাপাশি নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক ও চলচ্চিত্রসহ নানা আয়োজনে জাতির সূর্য সন্তানদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার উচ্ছ্বাস চিত্রিত হয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর এই আয়োজনে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এবারের বিজয় দিবস জাতির কাছে সঙ্গত কারণেই ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বয়সের ভেদাভেদ ভুলে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মেতেছিল আনন্দ আর উল্লাসে। চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী, গানের সুর, আবৃত্তি আর নাচের মুদ্রায় বিজয়ের উল্লাসে গোটা রাজধানীজুড়ে মূর্ত হয়ে উঠে মুক্তির উল্লাস, উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা।

শিল্পকলা একাডেমি : জাতীয় স্মৃৃতিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন, বাউল সংগীত পরিবেশন, স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী, শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজনে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। সকাল ৮টায় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। এরপর দুপুর ২টা পর্যন্ত স্মৃতিসৌধে দেশাত্মবোধক গান ও বাউল সংগীত পরিবেশন করে শিল্পীরা।

এ ছাড়া স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী, শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও আর্ট ক্যাম্পও অনুষ্ঠিত হয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে। বিকাল সাড়ে ৪টায় একাডেমি প্রাঙ্গণে জাতীয় সংসদ ভবনের অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পরিচালিত শপথ গ্রহণ করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সব দফতর-সংস্থার কর্মচারীরা।

চ্যানেল আই : ‘বিজয় ৫০’ শিরোনামে বিজয় মেলার আয়োজন করেছে চ্যানেল আই। এবারের মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ঐক্য.কম.বিডি। সকাল ১১টা ৫ মিনিটে ৫০টি পায়রা এবং ৫০টি লাল-সবুজ রঙের বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করেন বিভিন্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইমপ্রেস গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ মজুমদার, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি. চ্যানেল আই পরিচালনা পর্ষদ সদস্য জহিরউদ্দিন মাহমুদ বাবু এবং চ্যানেল আইর পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ প্রমুখ। মেলায় দেশের গান করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরীয় পরিয়ে তাদের হাতে সম্মাননাসূচক ক্রেস্ট তুলে দেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, চ্যানেল আই পরিচালনা পর্ষদ সদস্যরা। স্মৃতিচারণ করেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য ও অনুষ্ঠানে আগত মুক্তিযোদ্ধারা। শিল্পী মনিরুল ইসলামের নেতেৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রাঙ্কন করেছেন একদল শিল্পী এবং ছোট পরিসরে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংবলিত স্টলও ছিল মেলায়। মেলায় আবৃত্তি করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম, লায়লা হাসানসহ অনেকে। সংগীত পরিবেশন করেন চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠ, ক্ষুদে গানরাজ এবং বাংলার গানের শিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করেন চ্যানেল আই সেরা নৃত্যশিল্পীরা।

ছায়ানট : আলাপন, স্মৃতিচারণ, গীতআলেখ্য, একক সংগীত, আবৃত্তিসহ নানা আয়োজনে বিজয়ের সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট। বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে বিজয়ের ক্ষণে ছায়ানট ভবনের সামনে গীতি আলেখ্য ‘রূপান্তরের গান’ পরিবেশনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় ছায়ানটের এই আয়োজন। দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও নাচের সম্মিলনে সাজানো ছিল শাহরিয়ার কবির রচিত এই গীতিআলেখ্য। এরপর নতুন আঙ্গিকে সাজানো গীতিআলেখ্য “রূপান্তরের গান” মঞ্চস্থ হয় ছায়ানট মিলনায়তনে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্যরা। এর আগে ছায়ানট ভবনের সামনে জাতীয়সংগীত পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা, সহসভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল, নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : শেষ হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সম্প্রতির বাংলাদেশ’ শিরোনামের বিজয় উৎসব। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতীয়সংগীত পরিবেশন ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সকাল ১০টায় শুরু হয় সমাপনী দিনের আয়োজন। এরপর সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয়, কল্পরেখা, নৃত্যজন, মৈত্রী শিশুদল, এসওএস শিশুপল্লী, কল্যাণপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খেলাঘর, বধ্যভূমির সন্তান দল, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ৬টায় যাত্রাপালা ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’ পরিবেশন করে মানিকগঞ্জের চারণিক অপেরার যাত্রাশিল্পীরা। বিকালে মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি পীঠের আসরে স্মৃতিচারণা করেন শহীদের সন্তান। সাংস্কৃতিক পর্বে অংশ নেয়- চারুলতা একাডেমি, ঢাকা সিটি স্কুল, বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস, বধ্যভূমির সন্তান দল, সংগীত সমাজ কল্যাণপুর, যুববান্ধব কেন্দ্র (বাপসা)।

উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী : আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদ। ‘লাখো শহীদের বাংলাদেশ, মুক্তির লড়াই হয়নি শেষ’ এই স্লোগানকে ধারণ করে উদীচী চত্বরে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সহসভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান।

আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ঐক্য ন্যাপ-এর সভাপতি পংকজ ভাট্টাচার্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর কণ্ঠযোদ্ধা উদীচীর সাবেক সহসভাপতি মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্তা ও উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন। এতে আবৃত্তি পরিবেশন করে উদীচী বাড্ডা শাখা ও উদীচী কেন্দ্রীয় আবৃত্তি বিভাগ। নাটক ‘অজ্ঞাতনামা’ নাটক পরিবেশন করে কেন্দ্রীয় নাটক বিভাগ।

অন্তর কথা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ কেন্দ্র : বিজয় দিবস উদযাপনে দিনব্যাপী পাপেট শো’র আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন অন্তর কথা, সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ কেন্দ্র। দিবসের সকাল ৯টায় শুরু হয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত দুটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ ও আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির নানা বিষয় তুলে ধরা হয় এই পাপেট শোয়ে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট : আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিজয় উদযাপন করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বিকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হয় এই আয়োজন। সম্মেলক কণ্ঠে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ গেয়ে শোনায় গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে দলীয়নৃত্য পরিবেশন করে নাচের দল স্পন্দন ও বহ্নিশিখার শিল্পীরা।

একক সংগীত পরিবেশন করেন- মহাদেব ঘোষ, বিশ্বজিৎ রায়, আরিফ রহমান, শিমুল সাহা, শ্রাবণী গুহ রায়, মহনা দাস, নবনীতা জাইদ চৌধুরী। দলীয়সংগীত পরিবেশন করে- ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, ভিন্নধারা, সমস্বর। আবৃত্তি করেন- নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকুলি, অনন্যা লাবণী পুতুল, ইকবাল খোরশেদ, বেলায়েত হোসেন।

এর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় অংশ নেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, লেখক মফিদুল হক, মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন- আজহারুল হক আজাদ। এতে সভাপতিত্ব করেন বিজয় উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অভিনয়শিল্পী ঝুনা চৌধুরী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর