রবিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ইউরোপ যেতে বিভোর তরুণরা

দালালে সর্বস্বান্ত পরিবার ► সিলেটজুড়ে আদম পাচারের জাল ► লিবিয়ায় নিখোঁজ অর্ধশত যুবক

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট। ইউরোপ প্রবাসী নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না সিলেট বিভাগে। তাই এ অঞ্চলের তরুণরাও ইউরোপ যাত্রার স্বপ্নে বিভোর। যে কোনোভাবে ইউরোপের কোনো দেশে যেতে হবে- এ যেন তাদের আজন্ম স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রাণপ্রদীপ হারাচ্ছেন অনেকে। বিভিন্ন দেশে আটকে রেখে মুক্তিপণ হিসেবে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালালরা। এক সময় ইউরোপের স্বপ্ন ভেজে স্বজনদের কান্নার জলে। দালালদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া স্বজনরা শেষ পর্যন্ত ফিরে পান না বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিখোঁজ হওয়া তাদের পরিবারের সদস্যটিকেও। সম্প্রতি সিলেটের এমন একটি দালাল চক্রের সন্ধান মিলেছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, চক্রটি ইতালিতে পাঠানোর নাম করে লিবিয়ায় সিলেটের ২৫ তরুণকে জিম্মি করে রেখেছিল। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন সে দেশের পুলিশের গুলিতে। আর বাকি ২৪ জন কোথায় আছেন এরও খোঁজ মিলছে না সাত-আট মাস ধরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালালচক্র সিলেটের প্রবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ দেয়। অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোতে গিয়ে এজেন্টরা শুভাকাক্সক্ষী সেজে তাদের পরিবারের তরুণ সদস্যটিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। এতে পরিবার রাজি হলে দালালের ঠিকানা ধরিয়ে দেয় এজেন্ট। এরপর দালালচক্রের সদস্যদের সঙ্গে চলে ইউরোপ যেতে আগ্রহীদের চুক্তি। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার ২৫ জন তরুণকে ইতালিতে পাঠানোর চুক্তি করে ফরহাদ সিন্ডিকেট। আদম পাচারকারী ওই চক্রের প্রধান ফরহাদ আহমদ। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ঈদগাহ বাজারের বাসিন্দা ফরহাদ পর্তুগাল থাকেন। সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো সিন্ডিকেটের কার্যক্রম। ওই সিন্ডিকেটে তার স্ত্রী, মা, বোনসহ পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। ১০-১২ লাখ টাকায় বাংলাদেশ থেকে দুবাই ও লিবিয়া হয়ে ইতালিতে পাঠানোর চুক্তি করে তারা। চুক্তি অনুযায়ী তাদের লিবিয়া পর্যন্ত নেওয়া হয়। সেখান থেকে ট্রলারে করে তাদের ইতালি পাঠানোর কথা। কিন্তু লিবিয়ায় নেওয়ার পর ওই তরুণদের জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। একের পর এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় তাদের। দালালের হাত-বদলের সঙ্গে বাড়তে থাকে টাকার পরিমাণ। নতুন দালাল তাদের জিম্মি করে দেশের স্বজনদের টাকা পাঠাতে বাধ্য করে। বিয়ানীবাজারের ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালদের মাধ্যমে যে ২৫ জন তরুণ ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে লিবিয়া পর্যন্ত গেছেন, প্রায় চার মাস ধরে তাদের কোনো খোঁজ মিলছে না। এর মধ্যে লিবিয়ার ত্রিপোলির একটি জেল থেকে পালানোর সময় এক তরুণ মারা গেছেন। অপর একজন জেল থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি আবার আরেক দালালের কাছে আটক হন। ওই দালাল মুক্তিপণ বাবদ পরিবারের কাছ থেকে প্রায় ৫ লাখ টাকা আদায় করেছে। এখন ওই তরুণেরও খোঁজ মিলছে না। লিবিয়ায় নিখোঁজ তরুণের এক আত্মীয় জানান, দালালের সঙ্গে চুক্তি ছিল গন্তব্যে পৌঁছার আগে কোথাও পুলিশের হাতে আটক হলে দালাল তার নিজ দায়িত্বে ও খরচে মুক্ত করবে।

কিন্তু লিবিয়ায় যাওয়ার পর দালালরা চুক্তির কোনো কিছুই মানছে না। তারা নানা অজুহাতে শুধু টাকাই নিয়ে চলেছে।

বিয়ানীবাজার উপজেলার পূর্ব লাউজারী গ্রামের আতিকুর রহমান জানান, তার ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুনও দালালের মাধ্যমে ইতালিতে যেতে চেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি লিবিয়ায় নিখোঁজ রয়েছেন। দালালকেও এখন ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ। তার ছেলেসহ এলাকার যারা ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় অবস্থান করছিলেন, চার মাস ধরে তাদের কোনো খোঁজ নেই। তবে তাদের ধারণা, ওই তরুণরা হয়তো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে লিবিয়ার কোনো জেলে বন্দি আছেন। তারা বেঁচে আছেন। এখন সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের মুক্ত করে দেশে ফেরানো সম্ভব নয়।

লিবিয়ায় নিখোঁজ থাকা সিলেটের বিয়ানীবাজারের তরুণরা হলেন- পূর্ব লাউজারী গ্রামের তানহারুল ইসলাম, একই গ্রামের আবদুল্লাহ আল মামুন, হোসেন আহমদ, আবদুল্লাহ আল জুনেদ, আরিফ আহমদ দুলাল, খশিরবন্দ (হাতিটিলা) গ্রামের রাজু আহমদ, একই গ্রামের এনামুল হক, খশির কোনাপাড়া গ্রামের কামরুজ্জামান রাহাত, ঘুঙ্গাদিয়া নয়াগাঁও গ্রামের আবদুল আজিজ, একই গ্রামের আহমদ অজিত ও গড়রবন্দ গ্রামের আবদুল করিম। এ ছাড়া বিয়ানীবাজারের আমিনুর রহমান নামের এক যুবক লিবিয়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর