বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ক্লান্তিহীন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা

দক্ষিণ সুদানে অবকাঠামো উন্নয়ন

শিমুল মাহমুদ, দক্ষিণ সুদান থেকে ফিরে

ক্লান্তিহীন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা

দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতায় স্থিতিশীল পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশটির রাজধানী জুবার সঙ্গে বাকি অংশের কার্যকর কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। ফলে নতুন সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। তারা ইতোমধ্যে ৪৫০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ শেষ করেছেন। আরও ২৬০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ আগামী বর্ষার আগেই শেষ করার কর্মযজ্ঞ চলছে। বৈরী আবহাওয়া ও পাথুরে মাটির দেশ দক্ষিণ সুদানে বিষধর সাপ, পোকামাকড় ও মশার ব্যাপক উৎপাত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর ৩ শতাধিক সদস্য ম্যালেরিয়ায় ভুগেছেন। খাবার পানির তীব্র সংকট। এমনকি নির্মাণকাজের জন্যও ৫০-৬০ কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে কাজ করতে হয়। সীমাহীন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োজিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দেশটির উন্নয়নে দিনরাত ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অনন্য নজির স্থাপন করেছেন স্থানীয় মানুষের সেবায়।

রাজধানী জুবা ছাড়া সারা দেশের রাস্তা কাঁচা। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো ধাপে ধাপে পাকা সড়কে রূপান্তর ও মেরামতের কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা কাদা হয়ে যায়। আর সে কাদায় আটকে যায় যানবাহন। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার দিয়ে সে যানবাহন নিয়ে আসেন। দক্ষিণ সুদান সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এক বাক্যে বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নজিরবিহীন সেবা দিচ্ছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন ও মানবতার সেবা দিয়ে যাচ্ছে আন্তরিকভাবে। দক্ষিণ সুদানের আবহাওয়ায় ঋতু মাত্র দুটি। একটি শুকনো মৌসুম, অন্যটি বর্ষা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বর্ষা মৌসুম বেড়ে সাত মাস হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমের পাঁচ মাসে শান্তিরক্ষী ইঞ্জিনিয়ার সদস্যরা বাইরে যান কাজ করতে। কারণ বর্ষায় পাথুরে মাটিতে উন্নয়নকাজ করা যায় না। বাংলাদেশ কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ানের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার লে. কর্নেল তানভীর বলেন, ‘আমাদের কন্টিনজেন্টের সদস্য প্রায় ৩০০। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে এ কন্টিনজেন্ট এখানে কাজ করছে। অবিভক্ত সুদানে আমাদের সৈনিকরা কাজ করেছে। ১০ বছর ধরে দক্ষিণ সুদানের অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছি আমরা।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কন্টিনজেন্ট এখানে সড়ক নির্মাণ, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার করছে। আবহাওয়ার কারণে এখানে সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এগুলো নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব যানবাহন ও নির্মাণ সরঞ্জাম ব্যবহার করি তার সবই আমাদের নিজস্ব। এগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এসব সরঞ্জামের জন্য জাতিসংঘ আমাদের নির্ধারিত হারে ভাড়া দেয়।’ কন্টিনজেন্ট কমান্ডার আরও বলেন, ‘দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবার বাইরে রাস্তা তেমন একটা নেই। ফলে আমাদের যখন রাজধানী থেকে চার শ-সাড়ে চার শ কিলোমিটার দূরে গিয়ে নির্মাণকাজ করতে হয় তখন এসব নির্মাণসামগ্রী, রোড রোলার, ডাম্প ট্রাকসহ ভারী সরঞ্জামগুলো হেলিকপ্টারে করে নিতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘জুবা থেকে ইয়ামবিও পর্যন্ত ৪৫০ কিলোমিটার রাস্তা আমরা নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষণ করি। এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত বৈরী। এজন্য আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয়, সতর্ক থাকতে হয় সব সময়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এ রাজধানী থেকে যোগাযোগের সুবিধার্থে অনেক রাস্তা করে দিয়েছি। একটি রাস্তা “বাংলাদেশ রোড” নামে পরিচিত। রাস্তার কাজ করার সময় আমরা বিভিন্ন এলাকায় অনেক ফুটবল মাঠ করে দিয়েছি, যাতে এখানকার লোকজন খেলাধুলা করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৫ সাল থেকে এ দেশের উন্নয়নে কাজ করছি। আমাদের সৈনিকরা এখানে অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম করে কাজ করে। এ দেশের পাথুরে মাটির অনেক গভীরে পানি। অনেক সময় দেখা যায় ৫০-৬০ কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে রাস্তার কাজ করতে হয়। আমাদের সৈনিকদের নিষ্ঠা ও একাগ্রতার কারণে এখানকার স্থানীয় এবং জাতিসংঘের নীতিনির্ধারকরা আমাদের পছন্দ করেন।’ দক্ষিণ সুদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রাজধানীর জুবা মাল্টি সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দক্ষিণ সুদানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের কাজের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ সুদানে একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর