বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

নিয়ন্ত্রণহীন চালের বাজার

দুই মাসেও বাস্তবায়ন হয়নি মন্ত্রীর নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ টনের বেশি। স্বস্তিদায়ক মজুদ গড়ে উঠলেও বাজারে চালের দাম বাড়ছেই। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মিল মালিক ও আড়তদারদের নিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে বৈঠক করেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। ওই বৈঠকে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল বিক্রি হচ্ছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার বাইরেও। অথচ এই ‘বাম্পার ফলন’ কিংবা ‘ওএমএস’ চালে বাজারের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এমনও ঘটেছে, দু-এক দিনের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। চালের বাজারের এই অস্থিরতা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারও দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে।          জানা গেছে, বেশি লাভের আশায় অবৈধভাবে চালের মজুদ রেখে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়াই বাজারের অস্থিরতার অন্যতম কারণ। আর অবৈধ মজুদের ক্ষেত্রে খাদ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মজুদকারীদের যোগসাজশও রয়েছে। নীতিমালা উপেক্ষা করে অনুমোদিত পরিমাণের বেশি চাল মজুদ রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে সিন্ডিকেট। আর মাঠপর্যায়ের এই অসাধু কারবারিদের তথ্য খোদ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারাই গোপন রাখেন। এর ফলে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতর চাল ব্যবস্থাপনার সঠিক চিত্র পাচ্ছে না।

সূত্র জানায়, মজুদদারদের সঙ্গে কারসাজিতে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া জড়িত কর্মকর্তাদের সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট।

দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অভিযোগ, মাঠপর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারা ধান-চাল উৎপাদন, বিপণন ও বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে খাদ্য অধিদফতরকে সহযোগিতা করছে না। এমনকি যারা অবৈধভাবে ধান-চালের মজুদ রাখে, তাদের বিষয়ও গোপন করেন তারা। খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও তারা অবৈধ মজুদদারদের তথ্য জানাচ্ছেন না। শুধু সংশ্লিষ্টদের দেখানোর উদ্দেশে দু-এক জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। সঠিক তথ্য না পাওয়ায় মজুদদারদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।

মজুদদারদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করে রাজশাহীর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জিএম ফারুক হোসেন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় অভিযান চালিয়েছি। ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একজন মিলার ও দুজন ব্যবসায়ীকে অবৈধ মজুদদারির অপরাধে জরিমানা করা হয়েছে। দুই ব্যবসায়ীর লাইসেন্সও ছিল না। পরে তাদের কাছে থাকা মজুদ চাল ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতিতে বাজারজাত করা হয়েছে। এ ছাড়া নওগাঁয় তিন মিলারের সন্ধান পেয়েছি, যারা অবৈধভাবে মজুদ রেখেছেন। তাদেরও জরিমানা করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখেছি অনেক স্থানে লাইসেন্স ছাড়াই কেউ কেউ ব্যবসা করছেন। অবৈধভাবে মজুদ রেখেছেন। মজুদ নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত চাল মজুদ রাখলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।’

চালের বাজারের অস্থিরতা নিয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর এক সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার অবৈধ মজুদদারদের তথ্য জানাতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। অনুমোদিত পরিমাণের বেশি খাদ্যশস্য অবৈধভাবে মজুদকারীদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ৭ জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ, তার নির্দেশনার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অবৈধ মজুদদারদের তথ্য পাঠাননি কর্মকর্তারা। এরপর থেকেই সন্দেহের তালিকায় পড়েন জেলা খাদ্য কর্মকর্তারা।

৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বাজারে চালের অভাব নেই। মিল মালিকদের অবৈধ মজুদের কারণেই দাম বাড়ছে। তারা ধীরে ধীরে চাল ছাড়ছে। সাধারণ মানুষের কথা মাথায় নিয়ে এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নইলে সামনে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কারা অবৈধভাবে ধান-চালের মজুদ করছে তা জানাতে হবে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রককে। কেউ মজুদ না করলে সেটাও জানাতে হবে। পরে মজুদদারদের তালিকা অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে কোনো জায়গায় মজুদ করছে না বলে প্রতিবেদন দেওয়ার পর, সেখানে মজুদ পাওয়া গেলে সেই কর্মকর্তাকে ধরার কথাও বলেন মন্ত্রী।

কর্মকর্তাদের সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ধানের বাজার মিলাররা নিয়ন্ত্রণ করছে। চিকন চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে করপোরেট ব্যবসায়ী ও অটোরাইস মিলাররা। মিল মালিক ও আড়তদাররা চাল মজুদ করে মৌসুমের শেষ সময়ে দাম বাড়িয়ে তা বাজারে ছাড়ে। গত বছর অভিযানের মাধ্যমে এমন অনেক মজুদের চাল বের করা হয়েছে।

খাদ্য অধিদফতরের উপপরিচলক (সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন) মো. আফিফ-আল-মাহমুদ ভূঁঞা বলেন, মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা বিভিন্ন স্থানে অবৈধ মজুদদারির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছেন। রাজশাহী বিভাগে কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, গত ১৬ বছরে অর্থাৎ ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চালের উৎপাদন বেড়েছে ৪২ শতাংশ। চলতি আমন মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশের ধান-চালের ঘাটতি নেই। তবু দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর