বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

চেতনার ফাঁদে নিঃস্ব হাজারো পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক

চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের অফার ছিল সাধারণ সঞ্চয়ী পলিসিতে ১৮ থেকে ৩০ শতাংশ হারে মুনাফা। ফিক্সড ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছরে দ্বিগুণ মুনাফা। চেতনার এমন প্রলোভনে সায় দেওয়া ব্যক্তিদের প্রথম কয়েক মাস ঠিকমতোই মুনাফা দেওয়া হতো। এমন দৃশ্য দেখে রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার ও আশুলিয়া এলাকার হাজারো মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চেতনার ফাঁদে। কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। একের পর এক ভুক্তভোগীদের করা আবেদনে সাড়া দিয়ে অবশেষে চেতনার সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। মঙ্গলবার বিকাল ৫টা থেকে দিবাগত রাত ১টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৪ এর একটি দল আশুলিয়া এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণায় ব্যবহৃত নগদ অর্থ, মোবাইল ফোন ও ব্যাংক চেকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব বলছে, কমিটির সভাপতি মুহাম্মদউল্লাহ এখনো পলাতক রয়েছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- ইকবাল হোসেন সরকার, মাজহারুল ইসলাম, মমিন হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, ইব্রাহিম খলিল, এস এম মকবুল হোসেন, মিজানুর রহমান, আল-আমিন হোসেন, ফজলুল হক ও নুর হোসেন। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক জানান, আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার পরিবারের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা র‌্যাবকে জানান, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট গভর্নিং বডি নিয়ে ‘চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেশ কিছু বছর স্থানীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সঞ্চয়ে অধিক মুনাফা ও ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়েছিল। গায়েব হওয়ার কিছুদিন আগে এই সংস্থা বিস্তৃত হয়ে বড় পরিসরে কাজ করা শুরু করে। তাদের মূল টার্গেট ছিল আশুলিয়া ও সাভার এলাকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। তাদের অতি উচ্চ মুনাফা প্রদানের আশ্বাসে কোম্পানিতে সঞ্চয়ী পলিসি, এফডিআর, ডিপিএস, পেনশন পলিসি, শিক্ষা পলিসি, হজ পলিসি ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীকে পার্টনার পলিসিতে আকৃষ্ট করা হতো।

আসামিদের বরাত দিয়ে র‌্যাব-৪ অধিনায়ক বলেন, বিশ্বাস অর্জনের জন্য সংস্থাটি গ্রাহকদের প্রথম দিকে কয়েক মাস চুক্তি অনুযায়ী চেতনা লভ্যাংশ প্রদান করত, যা দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হতেন। অনেকে নিজের পেনশনের টাকা, গ্রামের ভিটাবাড়ি বিক্রি করা টাকা, বিদেশ থেকে কষ্ট করে অর্জিত টাকা ওই সংস্থায় উচ্চ মুনাফা লাভের আশায় জমা রাখেন।

 এভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ১৬ মার্চ অফিসে তালা দিয়ে লাপাত্তা হন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। র‌্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, সংস্থাটির অংশীদাররা বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে জায়গা-জমি কেনা, বহুতল ভবন নির্মাণ ও ছোট-বড় কারখানা করেছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে বিভিন্নভাবে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন তারা।

মোজাম্মেল হক বলেন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য তারা ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রচারণা চালাতেন। যদিও তাদের বিধি মোতাবেক কোনো ইসলামী শরিয়াহ বোর্ড ছিল না। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা সমিতির নামে রেজিস্ট্রেশনের কথা থাকলেও তা পলাতক সভাপতি মুহাম্মদউল্লাহ, তাজুল ইসলাম ও অজ্ঞাতদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তিতে ফ্ল্যাট বিক্রির প্রলোভনে টাকা নেওয়া হয়। দিনাজপুরের কাহারুলে সভাপতির নামে ১৬ বিঘা জমি থাকলেও তা বিক্রির চেষ্টা চলছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের কোনো অনুমোদন না থাকলেও ব্যবসায়ীদের উচ্চ সুদে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করত প্রতিষ্ঠানটি। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় গ্রাহককে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং মারধর করতেন তারা। সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ করা টাকা নিজেদের নামে সরিয়ে কমিটির কর্মকর্তারা নামে-বেনামে ফ্ল্যাট ও প্লট, বাগান, আবাদি জমি এবং বিভিন্ন ব্যাংকে নগদ টাকা লেনদেন করেছেন।

চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আসামিরা আরও তিনটি নামসর্বস্ব কোম্পানি চালু করেন। সেগুলো হলো- চেতনা পরিবার, চেতনা গার্ডেনিয়া (রিয়েল এস্টেট ব্যবসা) এবং চেতনা পরিবার কল্যাণ ফাউন্ডেশন। তবে চেতনা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ছাড়া বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কমিটির সভাপতি পলাতক মুহাম্মদউল্লাহ আশুলিয়ার নরসিংহপুরে বসবাস করলেও তিনি মূলত ভোলার বাসিন্দা। তিনি ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। আশুলিয়ায় তার পাঁচতলা বাড়ি এবং একাধিক ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রেফতার ইকবাল হোসেন সরকার মুহাম্মদউল্লাহর বন্ধু ও সমিতির সহসভাপতি। এ প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে বেশ কিছু ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। তদন্তের মাধ্যমে তাদের নাম-পরিচয় এবং প্রতারণায় কার কী ভূমিকা তা বেরিয়ে আসবে বলেও জানান র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর