শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ঈদযাত্রায় লুট হবে ৮ হাজার কোটি টাকা

যাত্রী কল্যাণ সমিতির সংবাদ সম্মেলন

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঈদযাত্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও চাঁদাবাজরা লুটে নেবে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। তাই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। গতকাল ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান। মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবারের ঈদে গণপরিবহন সংকটকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অতিলোভী কিছু অসাধু মালিক ও পরিবহন চাঁদাবাজের নেতৃত্বে ভাড়া-নৈরাজ্যের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও এ ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ করতে পারছে না। এবারের ঈদে ২৫ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সব পথে যাত্রী হতে পারে প্রায় ৬০ কোটি ট্রিপ। এর মধ্যে ৪০ কোটি ট্রিপ সড়কপথে, ২০ কোটি ট্রিপ রেল, নৌ ও আকাশপথে যাতায়াত হতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২৫ এপ্রিলের পর থেকে শহরাঞ্চলে রিকশা ভাড়া বেড়েছে ২০ ভাগ। আজ থেকে এ ভাড়া ১০০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন অটোরিকশা, ইজিবাইক ও লেগুনা চালকরাও।

তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মহোৎসব চলছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বিআরটিএ, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত নানাভাবে তৎপরতা চালিয়ে, কাউন্টারে কাউন্টারে জরিমানা আরোপ করেও এ ভাড়া-নৈরাজ্য ঠেকাতে পারছে না।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাত্রাপথে বিভিন্ন বাসে যাত্রীপ্রতি ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নৌপথেও ভাড়া-নৈরাজ্য চলছে। রেলপথে টিকিট কালোবাজারি, অনলাইনে টিকিট পেতে বিড়ম্বনা অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার অনেক বেশি। আকাশপথেও বেড়েছে ভাড়া। ফলে যাত্রীসাধারণ এখন দিশাহারা।

লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বরাবরের মতো এবারও আকাশপথে ভাড়া-নৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। ঢাকা-বরিশাল ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইলের উড়োজাহাজের ভাড়া দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ঢাকা-ব্যাংককের ভাড়ার প্রায় দেড়গুণ আদায় করা হচ্ছে। এ রুটে ইউএস বাংলায় ৪হাজার টাকার ভাড়া এখন ১০ হাজার ৮০০ টাকা। নভোএয়ারের ৪ হাজার ৮০০ টাকার ভাড়া এখন ৮ হাজার ৪০০ টাকা। বাংলাদেশ বিমানে ৩ হাজার টাকার ভাড়া ৭ হাজার ৪০০ টাকা। ঢাকা-সৈয়দপুর, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৪ হাজার ৫০০ টাকার নিয়মিত ভাড়া ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় ঠেকেছে।

গত বছর নভেম্বরে সরকার ডিজেলের মূল্য ২৩ ভাগ বাড়ানোর সময় বাসভাড়া ২৭ ভাগ ও লঞ্চভাড়া ৩৬ ভাগ বাড়ানো হলেও লঞ্চ মালিকরা নানা কারচুপির মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ হারে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে আসছিলেন। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটে আগে ডেকের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ৩৫০ টাকা হারে আদায় করা হলেও এবারের ঈদে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে। এক শয্যার কেবিনের ভাড়া ৯০০ টাকা ছিল। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ১ হাজার ২০০ টাকা করা হলেও এবারের ঈদে ১ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। দুই শয্যার ডাবল কেবিনের ভাড়া আগে ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ২ হাজার ৪০০ টাকা করা হলেও এখন আদায় করা হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। আবার কালোবাজারিরা আরও ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা বর্ধিত মূল্য নিয়ে যাত্রীদের হাতে টিকিট তুলে দিচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, সড়কপথে ঢাকা-চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি রুটে যাত্রীপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যা আগামীকাল থেকে দ্বিগুণে পৌঁছে যাবে। ঢাকা-রংপুর রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভাড়া আগে ১ হাজার টাকা নেওয়া হলেও এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ রুটে ঈগল পরিবহনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা নেওয়া হলেও এখন ১ হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। শাহআলী পরিবহন ৮৫০ টাকার ভাড়া ১ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-লালমনিরহাট শুভ বসুন্ধরায় ৮০০ টাকার ভাড়া ১ হাজার ৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-পটুয়াখালী সাকুরা পরিবহনের এসি বাসে ১ হাজার টাকার ভাড়া ১ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের পথে বিভিন্ন বাসে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার কিছু রুটে স্বল্প দূরত্বে যেতে চাইলেও টিকিট নেই অজুহাত দিয়ে বেশি দূরত্বের টিকিট নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

রেলে সার্বিক অব্যবস্থাপনার টিকিট না পেয়ে ৩৫০ টাকার টিকিট কালোবাজারির কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় কেনার খবর গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এবার সড়কপথে ৪০ কোটি ট্রিপযাত্রায় যাত্রীপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা বাড়তি দিলেও প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা এবং নৌ, রেল ও আকাশপথে ২০ কোটি ট্রিপযাত্রায় যাত্রীপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা অতিরিক্ত আদায় হলে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হবে। অর্থাৎ এবারের ঈদে নৈরাজ্যকারী সিন্ডিকেটের পকেটে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ভাড়া যাবে, যার ৪০ শতাংশ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট লুটে নেবে এবং বাকি ৬০ শতাংশ পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও নেতাদের পকেটে যাবে। এ নৈরাজ্যের কারণে নিম্ন আয়ের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস-ট্রাক ও ট্রেনের ছাদে, কাভার্ড ভ্যান, পণ্যবাহী পরিবহন ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত করতে বাধ্য হবে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁঁকি বাড়বে। তাই জরুরি ভিত্তিতে এ ভাড়া-নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

সর্বশেষ খবর