শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাসের জীবন্ত সংগ্রহশালা ‘হেরিটেজ আর্কাইভস’

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

ইতিহাসের জীবন্ত সংগ্রহশালা ‘হেরিটেজ আর্কাইভস’

হেরিটেজ আর্কাইভস। স্থানীয় ইতিহাসের যেন এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপকরণ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এই সংগ্রহশালাটি অবস্থিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাজলা এলাকায়। যেখানে আছে ১৮৭২ সালে করা প্রথম আদমশুমারির রিপোর্ট এবং সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট বা ভূমি জরিপের রিপোর্টের মতো দুষ্প্রাপ্য কিছু রিপোর্ট।

শুধু কি তাই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমানের প্রতিষ্ঠা করা এই সংগ্রহশালাটিতে রয়েছে বই-পুস্তক, সাময়িকী, পত্রিকা, ছোট কাগজ, এমফিল পিএইচডির গবেষণা জার্নাল, লিফলেট, পোস্টার, বুলেটিন, মেনিফেস্টো, স্মরণিকা, ফেস্টুন, ব্যঙ্গচিত্র, স্মারকচিহ্ন, পারিবারিক সরঞ্জাম ও জীবনী গ্রন্থের বিপুল সংগ্রহ।

সংগ্রহশালাটিতে ঢুকতেই বাম পাশে অবস্থিত দর্শনার্থীদের বসার জায়গা। এর পাশের একটি কর্নারে রয়েছে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীর ওপর লেখা অন্তত ৫ হাজার ২০০টি গ্রন্থ। যার মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনীর ওপর লেখা ৬০০, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ওপর ৩৫০ এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর ওপর ২৫০টি গ্রন্থ। নিচ তলায় আরও রয়েছে দেশের ৬৪টি জেলা নিয়ে লেখা প্রায় ১২ হাজার বই। আছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের গ্রন্থ, ডকুমেন্টস, লিফলেট, পোস্টারের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ম্যাগাজিন। তিন তলাবিশিষ্ট সংগ্রহশালাটিতে ৭/৩ ফুট আয়তনের ১৭৮টি বইয়ের তাকে আরও আছে কবি আবু বকর সিদ্দিক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের দেওয়া বই-পুস্তকের কর্নার।

৪০০টি বিষয়ের ওপর সংগ্রহ করা সংগ্রহশালাটিতে আছে প্রায় ৩ হাজার শিরোনামে ৩৫ হাজারের মতো সাময়িক পত্র-পত্রিকা এবং ৩ হাজার ২০০ ছোট কাগজ। সংগ্রহশালাটিতে আছে স্বল্প ভাড়ায় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপ করার জন্য একটি সেমিনার কক্ষ এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা গবেষকদের জন্য থাকা এবং রান্নার ব্যবস্থা।

সংগ্রহশালার তৃতীয় তলায় আছে পরিবারের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র সংবলিত একটি পারিবারিক আর্কাইভস কর্নার। যেখানে স্থান পেয়েছে পরিবারের কাজে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত হুকা, হারিকেন, কূপি, কলের গান, টেলিফোন সেট, রেডিও, কলম, দোয়াত, টাইপ রাইটার, সাইক্লোস্টাইল মেশিন, ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার, যাতা, খড়ম, পয়টা, পানের বাটা, কাঁসার বাসনপত্র, মাটির জিনিসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন জাতের ধান, মুদ্রা, বিয়ের কার্ড, বিয়ের শাড়ি, আমন্ত্রণপত্র ইত্যাদি।

সমৃদ্ধ এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কথা হয় অধ্যাপক মাহবুবর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তথ্য সংকটের কারণে স্থানীয় ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করতে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন অধ্যাপক মাহবুবর রহমান। তিনি দেখেন, কোথাও একই জায়গায় স্থানীয় ইতিহাসের ওপর তথ্য নেই। পরে ’৯০এর দশকে নেদারল্যান্ডসের একটি আর্কাইভসে গিয়ে দেখেন সেখানে পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ও সাময়িকী সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ড. মাহবুবর রহমান বাংলাদেশেও একটি হেরিটেজ আর্কাইভস গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। পরে ১৯৯৮ সাল থেকে লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার সংগ্রহ করতে শুরু করেন তিনি। এভাবে সংগ্রহ করতে করতে ২০০২ সাল থেকে বাসাবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হেরিটেজ : বাংলাদেশের ইতিহাসের আর্কাইভস’ নামের এই সংগ্রহশালা।

অধ্যাপক মাহবুবর রহমান জানান, ২০১১ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত হেরিটেজ আর্কাইভস পরিদর্শনে এসে অভিভূত হন। পরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হেরিটেজ আর্কাইভসের তিনটি ফ্লোর নির্মাণ করে দেন তিনি। ফলে বইপত্র রাখার স্থানের এখন আর তেমন অভাব নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও গত ১৪ নভেম্বর ২০২০ হেরিটেজ আর্কাইভস পরিদর্শন করেছেন। সংগ্রহশালাটি সংরক্ষণের জন্য দেশের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়ে অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, বর্তমানে সংগ্রহশালাটি একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। হেরিটেজ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আমি নিজেই। আমার ব্যক্তিগত অনুদানে এটি চলে। বর্তমানে সংগ্রহশালাটি দেখভাল করার জন্য ছয়জন স্থায়ী কর্মী আছেন। সব মিলিয়ে সংগ্রহশালাটি পরিচালনায় মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়। সংগ্রহশালাটির নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই। নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস করা গেলে আর্কাইভস নিয়ে কোনো চিন্তা থাকত না। বর্তমানে স্থানীয় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ডিজিটালাইজেশনের কাজ চলছে। অনেক লিফলেট, পোস্টার, ম্যাগাজিন ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। সমাজের বিত্তবান মানুষেরা যদি আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করেন তাহলে সংগ্রহশালাটি আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর