রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার কমার হার উদ্বেগজনক

জনসংখ্যা বিস্ফোরণের আশঙ্কা অধিদফতরের উদাসীনতায় থমকে গেছে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বিগত বছরগুলোতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিশুমৃত্যু হার হ্রাসে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার বৈশ্বিক পরিবর্তনের কারণে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো স্বাস্থ্যসেবা চলে গেছে মানুষের নাগালের বাইরে। কভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীসহ পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে যে প্রভাব পড়েছিল, করোনা চলে গেলেও সে পরিস্থিতি আর পরিবর্তিত হয়নি। অধিদফতরের উদাসীনতায় থমকে গেছে মাঠপর্যায়ের সেবা। নাটোর, কুমিল্লা, রাজশাহী, বরিশাল, যশোরসহ সারা দেশের এক ডজন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুসন্ধান চালিয়ে পাওয়া গেছে একই রকম তথ্য। স্বাস্থ্যসেবার জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের নিয়োগপ্রাপ্ত মাঠকর্মীরা এখন আর আগের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেন না। রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর অপ্রতুলতাও। এ ব্যাপারে কথা হয় নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বছর দুয়েক আগেও তার স্ত্রীর কাছে নিয়মিত আসতেন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী। সেখান থেকেই পিলসহ নানা জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ও পরামর্শ নিত তার পরিবার। কিন্তু এখন আর কেউ আসে না। তার ধারণা, সরকারি এই সুবিধা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। একই ধরনের চিত্র খুঁজে পাওয়া গেছে দেশের নানা প্রান্তে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে গতি আনার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু করোনাকালে ঘর থেকে বের না হওয়ার যে বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছিল, সেই বিধিনিষেধের পর আর সেবা কার্যক্রম গতি পায়নি। ফলে গোটা দেশেই যে যার মতো বসে বসে বেতন গুনছেন।’ এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না কেন- জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেখুন, ৬০-৭০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এই অধিদফতরে কাজ করেন। সেবা খাতের এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য ডায়নামিক নেতৃত্ব দরকার। সঠিক পরিচালনা ছাড়া এমন প্রতিষ্ঠানে সাফল্য আসবে না।’ তাহলে কি বর্তমান মহাপরিচালকের সেই ক্ষমতা নেই? এ প্রশ্ন সেই কর্মকর্তা এড়িয়ে গেলেও জানা গাছে পরিবার পরিকল্পনার বর্তমান মহাপরিচালক সাহান আরা বানু দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। অফিস করলেও এত বড় প্রতিষ্ঠানের সব দিক সামলানোর অবস্থায় তিনি নেই। তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাবও প্রতিষ্ঠানে পড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর স্থায়ী ও অস্থায়ী সাতটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছে তাদের বুকলেটে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সেবা ও কার্যক্রমের পরিধি সুবিশাল হলেও এখনো জন্মনিয়ন্ত্রণই তাদের প্রধানতম কাজগুলোর একটি। অধিদফতরের বুকলেট অনুযায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণে স্থায়ী ও অস্থায়ী সাতটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ রয়েছে। এগুলো হলো- খাওয়ার বড়ি, কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন, ইমপ্ল্যান্ট, আইইউডি, ভ্যাসেকটমি ও টিউবেকটমি। এর মধ্যে ভ্যাসেকটমি বা এনএসভি পুরুষদের স্থায়ী পদ্ধতি ও টিউবেকটমি বা লাইগেশন মেয়েদের স্থায়ী পদ্ধতি। আর অস্থায়ী পদ্ধতির মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট ও আইইউডি দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি। তবে অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী খাওয়ার বড়ির মতো বিপুলসংখ্যক না হলেও অনেক নারী ইনজেকশনও গ্রহণ করছেন। এই ইনজেকশন প্রতি তিন মাস পর নিতে হয়। মূলত এই পদ্ধতিগুলোর ব্যবহারেই ভাটা পড়েছে বলে জানা গেছে। ফলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪ অনুযায়ী, সাত বছর ধরে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ এবং নিট প্রজনন হার ২.৩ শতাংশ হয়েছে। প্রজননের হার কমিয়ে ১ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে। তবে দেশের বাকি অংশের তুলনায় ঢাকা বিভাগের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার খুবই কম। আসলে গত কয়েক বছরে এ মাত্রা শতাংশের দিক থেকে কিছুটা কমেছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ১০ কোটি ৮৮ লাখ ২৭ হাজার ৩৭০ জনের মধ্যে ৮ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার জনকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে দেওয়া হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৯২ হাজার ৫১৭ জনের মধ্যে ৮ কোটি ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৬৭টি সামগ্রী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার কমেছে আশঙ্কাজনক হারে।

একইভাবে গোটা বছরের পরিসংখ্যান টানলে দেখা যাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার শতকরা প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি কমে এসেছে। দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে এটি বড় প্রভাব রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেবা খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে নানা অভিযোগে রীতিমতো ধুঁকছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। দেশজুড়ে কেন্দ্রগুলো পরিণত হয়েছে দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায়। পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, নারী কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে দুদকের মামলা পর্যন্ত রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি আস্তে আস্তে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। যে প্রতিষ্ঠান সেবার মানসে সরাসরি সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, সেটির এমন বেহাল দশায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে সচেতন নাগরিক সমাজ। এদিকে দেশজুড়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালালেও ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও সেটি নবায়নের কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।

সব মিলিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর এখন তার বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে কেবল সরকারি সুযোগ-সুবিধাই নিচ্ছে। মাঠপর্যায়ের সেবা তো দূরে থাক, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পর্যন্ত নিজেদের দায়িত্বের ব্যাপারে অসম্ভব রকম উদাসীন। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। প্রতি ১ বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ১২০ জন মানুষের বাস এ দেশে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধে আশির দশকে সরকারি উদ্যোগে শুরু হয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি। গঠন করা হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। সেই কর্মসূচি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে জন্মনিরোধ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অপ্রতুলতায়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম হারিয়েছে গুরুত্ব।

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর