বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

রাজশাহীতে আউটসোর্সিং নিয়োগের নামে প্রতারণা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহীতে রাজস্ব খাতভুক্ত আউটসোর্সিংয়ে ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বেতন-ভাতা না দিয়ে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভয়ংকর প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে।

শুধু তা-ই নয়, রাজশাহী সিভিল সার্জনের আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ তিন মাসের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর ‘আউটসোর্সিং’য়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের যে প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছিল, এর মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়েছে। এর পরও টাকার বিনিময়ে ওই প্রকল্পেই জনবল নিয়োগ দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। তাদের চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে মাসের পর মাস বেতন না দিয়েই খাটানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজশাহী সিভিল সার্জনের মাধ্যমে রাজস্ব খাতভুক্ত আউটসোর্সিং হিসেবে অনুমোদিত ৮৬টি পদে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের একটি প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনিক এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনঃ দরপত্রের মাধ্যমে বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসব জনবল নিয়োগের অনুমোদন পায়।

 কিন্তু শুরু থেকেই এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ঘুষের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের অভিযোগ ওঠে।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পদে রাজশাহী সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৬ জন জনবল সরবরাহের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় অর্ধেক জনবল টাকার (ঘুষ) বিনিময়ে নিয়োগ দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। নিয়োগ দেওয়া এসব কর্মচারীকে এনআরবিসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় অ্যাকাউন্ট (হিসাব নম্বর) খুলতে বলে প্রতিষ্ঠানটি। নিয়ম অনুযায়ী কর্মচারীরা নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলেন।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিধিমালা অনুযায়ী, নিয়োগপ্রাপ্তদের মাস শেষে বেতন পরিশোধের কথা থাকলেও ৩০ জুন (প্রকল্পের মেয়াদ) পর্যন্ত কাউকেই বেতন দেওয়া হয়নি। পরে ২০২১-২২ অর্থবছরের মেয়াদ শেষ হলে কর্মচারীরা বেতনের জন্য চাপ দেন। তখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের ব্যাংক হিসাবের বহি জমা নেয় এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে তিন মাসের বেতন দেওয়া হবে মর্মে তিনটি চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মচারীই তিন মাসের বেতন পাননি।

তানোর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১ এপ্রিল নিরাপত্তা প্রহরী পদে নিয়োগ পাওয়া এনামুল হক বলেন, ‘৩০ জুনের পর আমার অ্যাকাউন্টের চেকবই জমা নেওয়ার পাশাপাশি তিন মাসের জন্য একটি চেকে ৪৩ হাজার ১৩ টাকার স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। চাকরিতে যোগদানের ছয় মাস চলছে অথচ বেতন পেয়েছি মাত্র দেড় মাসের ২১ হাজার টাকা।’ মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্মরত গাজিউর রহমান বলেন, ‘কর্মসংস্থান ব্যাংকের নওহাটা শাখায় কর্মরত খাজা মঈনুদ্দিন নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার বন্ধু পবার দারুশা কেন্দ্রীয় দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক মাহিনুর রহমানের পরিচয় ছিল। এর সূত্র ধরে আউটসোর্সিংয়ে চাকরির নেওয়ার জন্য আমি ওই ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার সহযোগী শিরোইল কলোনি হাইস্কুলের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক লিটন আলীর মাধ্যমে বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসের লোকাল প্রতিনিধিকে এপ্রিল মাসে তিন কিস্তিতে নগরীর দড়িখরবোনা মোড়ে গিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিই। আমি ২ মাস ২০ দিন পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ছিলাম। সেখানেও কোনো টাকা পাইনি। ১ জুলাই মোহনপুরে বদলির পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বেতন দেওয়া হয়নি।’

শিরোইল সাব সেন্টারের (স্বাস্থ্য) আয়া মমতাজ খাতুন বলেন, ‘আমি ৫ মে আয়া পদে যোগদান করি। যোগদানের আগে নাটোরের সিংড়া উপজেলার জুয়েল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে শাওনকে (জাকির হোসেন শাওন, বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেডে রাজশাহীর কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা) ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে এখন বিনা বেতনে কাজ করতে হচ্ছে।’

বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেডের রাজশাহীর কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন শাওন বলেন, ‘আমি কোনো নিয়োগ-বাণিজ্য করিনি। আমি শুধু আমার ভাগ্নে-ভাতিজাসহ (নিকটাত্মীয়) ছয়জনকে চাকরি দেওয়ার সুপারিশ করেছিলাম, যার জন্য আমার ভাগের ৪ লাখ টাকা তা ছেড়ে দিয়েছি। তবে মালিকপক্ষ নিয়োগ দেওয়ার সময় জনপ্রতি ৪০-৫০ হাজার নেন।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলাম সুলতানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মো. ফারুক বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য আউটসোর্সিংয়ের জনবল নিয়োগের মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য ইতোমধ্যে আমরা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। যদি অনুমতি না দেয় তাহলে নতুন করে টেন্ডার করে নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে জনবল নিয়োগ কিংবা বেতন পাননি এমন কোনো অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেননি। অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর