রবিবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ব্যাচ পড়াতে ব্যস্ত স্কুল কলেজের শিক্ষকরা

‘স্যার’দের দখলে চকবাজার

ইমরান এমি, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরীর শিক্ষা খ্যাত চকবাজারে সর্বত্র স্যারদের ব্যানার-পোস্টার। এসব স্যার সরকারি চাকুরে কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নন। এদের অধিকাংশই কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। নামের আগে-পরে ‘স্যার’ বিশেষণ বসিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন কোচিং ব্যবসা। এদের দেখাদেখি বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা এই এলাকায় ব্যাচ পড়ানো শুরু করছেন। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা ক্লাসবিমুখ হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিটি ভবন ও শপিং মলের দেয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে নানা রঙের বড় বড় ব্যানার ও পোস্টার। আর তাতে বড় অক্ষরে লেখা থাকে নানা স্যারের ব্যাচভিত্তিক নির্দিষ্ট বিষয়ের নাম। তেমনই একটি ব্যানার চোখে পড়ে ফ্রেশইন আবাসিক হোটেল ভবনে। তাতে লেখা আছে ‘এইচএসসি রসায়ন কোর্স অভিজ্ঞতার ২৮ বছর মনছুর স্যার, এম.ফিল (নিউক্লিয়ার রসায়ন) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন ব্যাচে ভর্তি চলছে। শুধু মনছুর স্যার নয়, আছে গণি স্যারের ইংরেজি, ডা. রিজভী স্যারের এইচএসসি জীববিজ্ঞান, নাজিম স্যারের ইংরেজি, শওকত স্যারের ইংরেজি, নুর মোহাম্মদ স্যারের উচ্চতর গণিত, শাহাদাত স্যারের কমার্স, বাবু স্যারের গণিত, রাহুল স্যারের ইংরেজি, হাসিব স্যারের পদার্থবিজ্ঞানসহ নানা স্যারের কোচিংয়ের আকর্ষণীয় বড় বড় ব্যানার, বিলবোর্ড ও পোস্টার।

এসব কোচিং সেন্টারের শিক্ষক হিসেবে যারা আছেন তারা সারা বছরই এভাবে চকবাজার এলাকায় কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এসব কোচিং সেন্টারে এক সময় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বেকার যুবকরা শিক্ষকতা করতেন। এখন তাদের দেখাদেখি দিন দিন এতে যুক্ত হচ্ছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সময় দেওয়ার চেয়ে তারা ব্যস্ত থাকেন কোচিং সেন্টার আর ব্যাচ পড়ানো নিয়ে। যার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগী না হয়ে কথিত ‘স্যার’দের অনুপ্রেরণায় ঝুঁকছে কোচিং সেন্টারের দিকে। যেসব শিক্ষার্থীর ব্যাচ বা কোচিংয়ে পড়ার সামর্থ্য নেই, তারা ঝরে পড়ছে শিক্ষা থেকে।

তেমনই একজন ‘স্যার’র সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, যেসব শিক্ষার্থী একটি সাবজেক্টে পড়তে চান তাদের সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস করানো হয়। আর যদি সব বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হয় তাহলে তাদের নিয়ে আলাদা একটি কোর্স থাকে। সেখানেও তারা ‘স্যার’দের সময়মতো পড়েন। যারা এক সাবজেক্টে পড়েন তাদের প্রতি মাসে ২ হাজার আর যারা সব বিষয়ে পড়েন তাদের দিতে হয় ১২ হাজার টাকা। তবে টাকা দিলেও এসব কোচিং সেন্টারের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অভিভাবকদের।

জানতে চাইলে আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ আনোয়ারা আলম বলেন, কোচিং ব্যবসা কিন্তু শুরু হয় শিশুকাল থেকে। তথাকথিত ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোচিং সেন্টারে কচিকচি শিশুদের নিয়ে অভিভাবক বিশেষত মায়েদের কি দৌড়! আহা! আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা! এর অবকাশে যেমন গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক তথাকথিত কিন্ডারগার্টেন, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও। আমরা শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়মিত কাটাছেঁড়াই দেখছি। কিন্তু কোনোভাবেই কোচিং ব্যবসা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে সঠিকভাবে তদারকি বা যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো ব্যবস্থাও দেখি না।

জানি না এই রাহু থেকে কখন মুক্তি পাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এখন পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে শিক্ষার কারিকুলাম। কিন্তু যতটা ভিতরে গেছি মনে হয় না কোচিং ব্যবসা বা কিছু শিক্ষকের প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতা বন্ধ হবে। এখন প্রয়োজন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রযুক্তি ও দক্ষতানির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা। একই সঙ্গে প্রয়োজন পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন!! নয়তো কোচিং ব্যবসা চলতেই থাকবে।

সর্বশেষ খবর