চট্টগ্রামে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগরীর আটটি থানা। পাশাপাশি হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফলে থানাগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। সারা রাত চলে এই তান্ডব, পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, এমনকি ল্যাপটপ পর্যন্ত লুট করা হয়েছে। এতে ধ্বংস হয়েছে আটটি থানার বিভিন্ন মামলার অধিকাংশ নথি। ফলে পুড়ে যাওয়া নথিভুক্ত মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিছু নথিপত্র অনলাইনে মিললেও অধিকাংশ নথি পাওয়া যাবে না। তবে এই ধ্বংসস্তূপে বসেই পুলিশি সেবা দিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (সিএমপি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের থানাগুলোর যেসব মামলার নথি পুড়ে গেছে সেসব নথি কীভাবে রিকভারি করা যায় তার পরিকল্পনা চলছে। আবার মামলার নথি কিছু সার্কেল অফিস, ডিসি অফিস ও কোর্টেও থাকে। আবার অনেক নথি থাকে সিডিএমএস সার্ভারে, সেন্ট্রালিও থাকে। ওখান থেকে মামলার নথি নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যেসব মামলার নথি পাওয়া যাবে না, সেক্ষেত্রে আইন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে মামলাটির কাজ এগিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপে বসেও পুলিশ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। সাধারণ মানুষও পুলিশকে হেল্প করছে। মানুষকে আমরা সচেতন করছি। কীভাবে পুলিশি সেবা আরও বাড়ানো যায়, নাগরিক নিরাপত্তা বাড়ানো যায় তা নিয়ে। যদিও এখন মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবহন সংকট। পরিবহন না থাকায় টহল ডিউটি থেকে শুরু করে সব কাজে করতে বেগ পেতে হচ্ছে। যদিও ভাড়া কওে থানাগুলোর পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে ১০টি গাড়ি ছিল, সেখানে এখন ৫-৬টি গাড়ি দিয়ে কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আটটি থানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পতেঙ্গা ও কোতোয়ালি থানা। পাহাড়তলী থানার দেয়াল ছাড়া অবশিষ্ট কোনো কিছুই রাখেনি দুর্বৃত্তরা। একই চিত্র ইপিজেড থানার। ক্ষতবিক্ষত ডবলমুরিং থানা, হালিশহর থানা, সদরঘাট থানা ও আকবরশাহ থানা। থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্সগুলো চেনার কোনো উপায় নেই। দেখলে বোঝা যাবে সুপরিকল্পিতভাবে চালানো হয়েছে এসব ধ্বংসলীলা। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালাও-পোড়াওয়ে ক্ষতবিক্ষত আটটি থানা যেন ধ্বংসযজ্ঞের নীরব সাক্ষী। লুট হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, এসি, ফ্যান, জব্দকৃত মোটরসাইকেল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর আমরা থানায় থানায় যোগদান করেছি।
ধ্বংসযজ্ঞে বসেই সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এরপরও মনে অজানা আশঙ্কা ভর করছে। কোন সময়ে কী হয় তা নিয়ে আমাদের পরিবারও শঙ্কিত। সিএমপি সূত্র জানায়, সিএমপির ১৬ থানার মধ্যে আংশিকসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ থানা। ৩১টি ফাঁড়ির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯টি। এর বাইরে মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয় দামপাড়া পুলিশ লাইনের সামনের অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিএমপির যানবাহন পোড়ানোর ক্ষয়ক্ষতি আনুমানিক ২০ কোটি টাকা। এরমধ্যে কানাডার তৈরি ৫ কোটি টাকার একটি এপিসি কোতোয়ালি থানায় পোড়ানো হয়েছে। এ ছাড়াও আরও ৪২টি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। সরকারি মোটরসাইকেল পোড়ানো হয়েছে ৪৫টি। বেসরকারি মোটরসাইকেল পোড়ানো হয়েছে শতাধিক। তবে সিএমপির সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত তা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এদিকে সিএমপির ক্ষতিগ্রস্ত আটটি থানার মধ্যে কোতোয়ালি, পাহাড়তলী, আকবর শাহ, ইপিজেড, সদরঘাট ও পতেঙ্গা থানাসহ মোট ছয়টি থানায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৫৮৯টি মামলার নথি। তারমধ্যে কোতোয়ালিতে ১৮৭, পতেঙ্গা থানায় ১০১, আকবর শাহ থানায় ১০২, পাহাড়তলীতে ৯১, ইপিজেডে ৬৬ এবং সদরঘাট থানায় পুড়ে গেছে ৪২টি মামলার নথিপত্র। পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মামলার কিছু নথি সিডিএমএস সার্ভারে থাকে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ম্যানুয়াল পরোয়ানা রেজিস্টারও ম্যানুয়াল থাকে না। এসব তো আর জোগাড় করা যাবে না। আটটি থানায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আসবাবপত্র, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, হাজারের বেশি তদন্তাধীন মামলার নথি, আলামত, এজাহার, চার্জশিট, আসামিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। ফলে পুলিশকে আদালতে ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় বিপাকে পড়তে হবে। নথি পুড়ে যাওয়া এসব মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।