স্বাধীন সাংবাদিকতায় আজও বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার লড়াই চলছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা এবং সামাজিক মাধ্যমে হুমকি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন থাকা দরকার। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। কেউ কেউ কারাবন্দি হয়েছেন, তবে তা তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য। তারা একই সঙ্গে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা আরও চ্যালেঞ্জের মুখে। এ অবস্থায় এ দেশের সাংবাদিকদের আরও সাহসী হতে হবে। বৈশ্বিক বাস্তবতায় সাহসী হওয়া কঠিন হয়েছে।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫ উপলক্ষে গতকাল সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কার্যালয়ে ‘সাহসী নতুন বাংলাদেশ : গণমাধ্যমের স্বাধীনতার রোডম্যাপ সংস্কার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব বলেন। ইউনেস্কো ঢাকা অফিস, টিআইবি ও সুইডেন দূতাবাস যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এবং টাইমস মিডিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ, ইউনেস্কোর প্রতিনিধি সুশান ভাইজ, সুইডিশ রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, বিজেসির চেয়ারম্যান রেজওয়ানুল হক রাজা এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপির ব্যুরো প্রধান শেখ সাবিহা আলম। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, সংবাদমাধ্যমের নীতিনির্ধারণী পর্যায়, যেখানে খবর বা মতামত তৈরি হয় সেখানে অবশ্যই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকা উচিত। পার্লামেন্টিয়ানদের প্রশ্ন করা যাবে, জুডিশিয়ারিকে প্রশ্ন করা যাবে, সিকিউরিটি এজেন্সিকে প্রশ্ন করা যাবে কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্ন করা যাবে না। আমি চাই না জিনিসটা থাকুক।
তিনি বলেন, ক্ষমতার পালাবদলের পর মূল যে অভিযোগ সেটা দিয়ে মামলা হয় না। করা হয় হত্যা মামলা। বিষয়টি নিয়ে সরকারও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছে। বিষয়টি আমরাও বলার চেষ্টা করছি, আইন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কথা বলছি বিষয়গুলোকে একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্য। মামলা হওয়া আর আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়া আলাদা। মামলা যে কেউ করতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কাউকে আটকে রাখছে কি না। রাখলে সেটা আইন অনুযায়ী হচ্ছে কি না, না হলে সেটা নিয়ে আপনারা কথা বলতে পারেন।
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা দেখিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা লুটপাট করা হয়েছে। মন্ত্রীকে বা মন্ত্রীর ওপরের লোককে দিয়ে কল করিয়ে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। সে সময় লুটপাটের একটা পলিটিক্যাল ইকোনমি গড়ে উঠেছিল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের হার নিয়ে অনেক কথা আছে। বর্তমানে সার্কুলেশন দেড় লাখের বেশি হলে বিজ্ঞাপনের হার ৯৫০ টাকা ধরা হয়। মূল্যস্ফীতির তুলনায় এটা এখন অন্যায্য। পাশাপাশি যারা নিজেদের পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ২ হাজারও না সেটাকে দেড় লাখ, ২ লাখ বানিয়ে রাষ্ট্রের টাকা লুটপাট করেছে, সেগুলো তদন্ত করা হবে। রাষ্ট্রের টাকায় বিজ্ঞাপনের নামে নেতা, মন্ত্রী ও এমপিরা পত্রিকা চালু করেছেন। আমরা মনে করি, গত ১৫ বছরের সংবাদমাধ্যমের অবস্থা নিয়ে খুব শিগগিরই একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস করা দরকার। আমাদের উদ্যোগ আছে, এটা মন্ত্রণালয় থেকেও হতে পারে, আরেকটা আলোচনা চলছে, এটা জাতিসংঘ থেকে হতে পারে। বিগত সময়ে গণমাধ্যম কীভাবে রাজনীতিকরণ হয়েছে সেটাও জানা দরকার। সাংবাদিকরা কতটা চাপে ছিলেন, কোন হাউস কী নীতিমালা করেছে, এর কারণে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কীভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে সেটা আমাদের জানা দরকার আছে, মানুষ যেটা জানতে চায়। আর বিটিভি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও বাংলাদেশ বেতারকে একত্র করে একটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার পক্ষে আমি। তবে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে। সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন তাৎক্ষণিকভাবে করা সম্ভব। ওয়ান হাউস ওয়ান মিডিয়া যে নীতির কথা বলা হয়েছে, তা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
নোয়াব সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম ও স্বাধীন সাংবাদিকতার অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। আগে কথা বলার অবস্থা ছিল না। স্বাধীনতার পর দেখেছি কোনো সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে আমরা ১৬ ধাপ এগিয়েছি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে। এই ১৬ শতাংশ অগ্রগতি আগামী দিনে ৩২ শতাংশ পিছিয়ে যাবে না, তার কোনো গ্যারান্টি আমরা দিতে পারব? আর নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে সরকারের প্রেস কাউন্সিল বড় বাধা। প্রেস কাউন্সিল একটি পঙ্গু ও প্যারালাইজড অর্গানাইজেশন। এর কোনো ভূমিকা নেই। সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান।
নোয়াব সভাপতি বলেন, সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে যে, একজন ব্যক্তি দুটি গণমাধ্যমের মালিক হতে পারবে না। এ কথা আমার দিকেও আসে। তবে এটা আমি মানতে পারি শর্তসাপেক্ষে। আপনার আমার নিরাপত্তা দেবে কে? একজন সাংবাদিক অপরাধ করলে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জেলে মারা যেতে হবে কেন। মুশতাক আহমেদকে (কারাগারে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ) কেন জীবন দিতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিল তার? এটি নিয়ে কেউ কখনো কথা বলেছি? কথা বলার অবস্থা ছিল না। মফস্বল সাংবাদিকরা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে সাংবাদিকতা করেন। সমকালের দুই মফস্বল সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। সাংবাদিকতা না থাকলে কে আমার জীবনের নিরাপত্তা দেবে, কে আমার সম্পদের নিরাপত্তা দেবে এবং কে সমাজকে নিরাপত্তা দেবে?
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে সামান্য আপত্তি উঠেছে। সাংবাদিকদের জন্য একটি জাতীয় ন্যূনতম বেতন স্কেল নির্ধারণ, যা সমতুল্য সরকারি চাকরির বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সমালোচকরা বলছেন, আর্থিক সংকটে থাকা খাতের জন্য এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং এটি মানা হলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ নিবিড়ভাবে যাচাই করলে দেখা যায়- ২০১৪ সালে ঘোষিত অষ্টম ওয়েজ বোর্ড যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হতো (নিয়মিত ইনক্রিমেন্টসহ), একজন রিপোর্টার বা সহসম্পাদকের বেতন এতদিনে নবম গ্রেডের সরকারি কর্মচারীর সমতুল্য হতো। ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নীতিগত সহায়তা, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো পশ্চিমা দেশগুলোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তির সহযোগিতায় ইসরায়েল হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এআইয়ের সামরিক ব্যবহার চলছে। এমনকি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়েও অনেক সংবাদমাধ্যম বন্ধ হতে দেখা গেছে।