মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মাছের ভান্ডার কাপ্তাই হ্রদ

ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি

মাছের ভান্ডার কাপ্তাই হ্রদ

সুস্বাদু দেশি মাছের সমৃদ্ধিশালী জলভান্ডার কাপ্তাই হ্রদ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কাপ্তাই হ্রদ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলধারা। বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির মাছের ভান্ডার নামে পরিচিত। এটি রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় অবস্থিত। এ হ্রদকে মৎস্য প্রজাতির বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধিশালী জলভান্ডার বলা হয়। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ১৯৬৪ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে ২ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির ডলফিন, ২ প্রজাতির কচ্ছপসহ ৭৬ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ছিল। এর মধ্যে ৬৮ প্রজাতির দেশীয় ও ৮ প্রজাতির বিদেশি মাছ ছিল। এ মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হতো। কিন্তু কালের পরিবর্তন ড্রেজিংয়ের অভাব, গভীরতা হ্রাস, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ হ্রদের বহু প্রজাতির মাছ। ক্রমাগতভাবে তা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ৪২টি প্রজাতির। এত কিছুর পরও এখনো ৩৫ প্রজাতির মাছ রাঙামাটি হ্রদ থেকে বাণিজ্যিকভাবে আহরিত হচ্ছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হচ্ছে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। কাপ্তাই হ্রদ থেকে বর্তমানে মাছ আহরণ হচ্ছে রুই, কাতল, কালিবাউশ, কাচকি, চাপিলা, আইড়, বোয়াল, গজার,  শোল, মাগুর, শিং, কই, তেলাপিয়া, বাঁচা, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, কার্পিও, রাজপুঁটি, তেলে নাইলোটিকা, তেলে মোজাম্বিকা, থাই মহাশোল, আফ্রিকা মাগুর, থাই পাঙ্গাশ, চিতল, সিল, দেশি সরপুঁটি, বাটা, কাকিলা, দেশি পাঙ্গাশ, মৃগেল, টাকি, বাঁশপাতা, বাইম, ফলি, টেংরা, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, কাজরী, ঘনিয়া, কাটা মাইল্যা, ইল্যা, টিংড়ি, পুঁটি। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) বলছেন, চলতি বছর রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ থেকে মাছ আহরণ করা হয় প্রায় ৫১৬০.৬৮ মেট্রিক টন। এতে রাজস্ব আদায় হয় প্রায় ৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। এ টাকা গেল বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এভাবে মাছ উৎপাদন অব্যাহত থাকলে এ বছর রাজস্ব আয় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে। এ মাছের সঙ্গে জীবন ও জীবিকা জড়িত এ অঞ্চলের ২২ হাজার মৎস্যজীবী। আর হ্রদে মাছের সুষ্ঠু প্রজনন ও উৎপাদন লক্ষ্যে প্রতি বছর ১ মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

বন্ধকালীন সময় রাঙামাটি মৎস্য উন্নয়ন অধিদফতরের উদ্যোগে এ হ্রদে ছাড়া হয় বিপুল পরিমাণ পোনা মাছ। এসব পোনা বড় হওয়ার পর আবারও শুরু হয় মাছ শিকার। রাঙামাটি জেলা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আজহার আলী জানান, অনেক বছর ধরে হ্রদের ড্রেজিং না হওয়ার কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র ছিল-কাসালং চ্যানেলে মাইনীমুখ, বরকল চ্যানেলের জগন্নাথছড়ি, চেঙ্গী চ্যানেলের নানিয়ারচর ও রিংকং চ্যানেলের বিলাইছড়ি। এ চারটি নদীর চ্যানেলে মাছে সুষ্ঠু প্রজনন হতো। কিন্তু বর্তমানে কাসালং চ্যানেলে মাইনিমুখ ও রিংকং চ্যানেলে পলি জমাটের কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ২টি চ্যানেলে স্বাভাবিক থাকলেও কাপ্তাই হ্রদের দ্রুত ড্রেজিং করা না হলেও তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রাঙামাটিতে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদের রিসোর্স অনেক বড় এবং আকর্ষণীয়। কিন্তু সঠিক ব্যবহারের অভাবে এই হ্রদের সম্পদকে সমৃদ্ধিশালী করা যাচ্ছে না। তবে বিএফডিসি রাঙামাটির মারিশ্যার চরে একটি বিলা হেচারি স্থাপন  করেছে। এ হেচারিতে মাছের প্রাকৃতিগতভাবে প্রজনন ঘটিয়ে পোনা মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিশেষ করে কার্প জাতীয় মাছের পোনা। এ হেচারির উৎপাদিত পোনা মাছ সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে কাপ্তাই হ্রদের মাছের ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতে পারে। প্রসঙ্গত ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে সৃষ্ট  দেশের এই বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদটিকে মৎস্য সম্পদের ভান্ডারে পরিণত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর ১৯৬৪ সাল থেকে হ্রদ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য আহরণ শুরু হয়। এ ছাড়া ঋতু ও মৌসুমে ৯ ইঞ্চি সাইজের পর্যন্ত পোনা মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে।

সর্বশেষ খবর