সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অচল সিটি স্ক্যান-এমআরআই এনজিওগ্রাম-কোবাল্ট-৬০ টেস্ট

রাহাত খান, বরিশাল

অচল সিটি স্ক্যান-এমআরআই এনজিওগ্রাম-কোবাল্ট-৬০ টেস্ট

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটি স্ক্যান-এমআরআই এনজিওগ্রাম-কোবাল্ট-৬০ টেস্ট বন্ধ রয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব পড়তে শুরু করলেও সরকারি হাসপাতালে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নেই। দেশের দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ভরসা শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) করোনা ওয়ার্ডে রোগী দিন দিন বাড়ছে। হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোও করোনা আগের রূপে ফিরেছে। ওয়ার্ড ছাপিয়ে রোগীদের স্থান হচ্ছে বারান্দায় খোলা জায়গায়। তাদের সেবা দেওয়ার জন্য নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার-আয়া ও ওয়ার্ডবয়। বহিরাগত ১২৪ জন নারী পেটেভাতে কাজ করে ফুটফরমায়েশ করে রোগীদের। অন্যান্য দিন কালেভদ্রে ডাক্তার পাওয়া গেলেও শুক্র-শনিবার এই হাসপাতাল থাকে প্রায় ‘ডাক্তার শূন্য’। ডাক্তার না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কার্যক্রম পাঁচ মাস ধরে বন্ধ। আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর চালানোর জন্য পদ সৃজন করে বিশেষজ্ঞ পদায়ন হয়নি।

আজও। এদিকে হাসপাতালের জটিল রোগ পরীক্ষার কোটি কোটি টাকার ‘অচল’ ভারী যন্ত্রপাতিগুলো চালু করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

জন্য করোনাকালের শুরু থেকে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠলেও আজ পর্যন্ত একটি মেশিনও সচল করা হয়নি। এ কারণে রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার বেসরকারি বাজার ব্যাপক জমজমাট হয়ে উঠেছে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার নিগৃহীত হওয়াসহ এ নিয়ে ধর্মঘট পর্যন্ত হয়েছে ইন্টার্নদের। করোনা শুরুর আগে শেবাচিমে দৈনিক গড়ে রোগী ভর্তি থাকতেন প্রায় ২ হাজার। করোনা শুরুর পর করোনা ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ১১০ জন রোগী ভর্তি ছিল। সাধারণ ওয়ার্ডে রোগী কমে গিয়ে গড়ে ভর্তি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০। জুনে সর্বনিম্ন ১৮ জনে নেমেছিল করোনা রোগীর সংখ্যা। সাধারণ ওয়ার্ডে রোগী আগের চেহারায় ফিরে আসছে। গতকাল করোনা ওয়ার্ডে ৬৪ জনসহ হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৪১১জন রোগী ভর্তি ছিলেন। বিগত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ১৭ জন চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগী মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্বজনরা জরুরি প্রয়োজনে মুমূর্ষু অবস্থায় ডাক্তার না পাওয়ার অভিযোগ করেন। ডাক্তার না পাওয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনদেরও। এর বিপরীতে জনবল সংকটের যুক্তি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, ৫০০ শয্যা হাসপাতালের জনবল কাঠামো অনুযায়ী ডাক্তার থাকার কথা ২২৪ জন। আছেন ৯৪ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৪১৫ কর্মচারীর স্থলে আছেন ২৫০ জন। ২০১০ সালে হাসপাতাল ১ হাজার শয্যায় উন্নীত করা হলেও গত ১০ বছরে দ্বিগুণ জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়নি। ৫০০ শয্যার ঘাটতি জনবল দিয়ে বর্তমানে দেড় হাজার রোগীর সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। এ কারণে অভাব-অভিযোগ রোগী ও স্বজনদের নিত্য সঙ্গী। এই সুযোগে রোগীদের ফুটফরমায়েশ আর আর ট্রলি ঠেলে বখশিশ-কমিশন নিচ্ছে বহিরাগত ১২৪ জন ‘বুয়া’। কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে আবার ওয়ার্ড মাস্টারদের পার্সেন্টেজ দিয়েই নানাভাবে রোগীদের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। গত মার্চে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যোগদান করার পর লাপাত্তা হওয়া সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাখাওয়াত হোসেন গতকাল পর্যন্ত কর্মস্থলে ফেরেননি। এরপর ভরসা একমাত্র অভিজ্ঞ চিকিৎসক ডা. এ কে এম আজাদের গত ২৮ এপ্রিল অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ডাক্তার না থাকায় পরিচালক চিঠি ইস্যু করে জুনের শেষ সপ্তাহে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি বন্ধের নির্দেশ দেন।  করোনা ওয়ার্ডে ১২টি এবং সাধারণ ওয়ার্ডে ১০টি আইসিইউ বেড পরিচালনার জন্য পদ সৃষ্টি করে গতকাল পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অন্য ওয়ার্ড থেকে সাময়িক ডাক্তার এনে আইসিইউ চালানোর চেষ্টা করা হলেও সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা না থাকায় আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটর সুবিধা পাচ্ছেন না রোগীরা। একটু মুমূর্ষু হলেই রোগী পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। করোনা ওয়ার্ডে ডাক্তাররা এখনো থাকেন কক্ষবন্দী। নার্স-আয়াতে ভরসা রোগীদের। হাসপাতালের ২টি অত্যাধুনিক সিটি স্ক্যান মেশিন, এমআরআই, এনজিওগ্রাম, ক্যান্সার রোগ পরীক্ষার দুর্ভল কোবাল্ড-৬০সহ জটিল রোগ পরীক্ষার কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি করোনার শুরু থেকে সচল করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠলেও গতকাল পর্যন্ত মেশিনগুলো সচল করা হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকায় প্রতিদিন শত রোগীর আল্টাসনোগ্রাম হয় বাইরের ডায়াগনস্টিকে। দুটি এক্সরে মেশিন থাকলেও জনবল সংকটের অজুহাতে লাইন দীর্ঘ করে রোগীদের ডায়াগনস্টিকের দিকে ঠেলে দেয় সংশ্লিস্ট টেকনিশিয়ানরা। এসব ডাগায়নস্টিকের কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে গত ২০ অক্টোবর ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হাতে এক সিনিয়র লাঞ্ছিত হন ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ইন্টার্নরা মধ্য রাতে জরুরি বিভাগের গেট আটকে বিক্ষোভসহ টানা তিন দিন কর্মবিরতি করেন। ওই সময় উভয়পক্ষই কমিশন নিয়ে পরস্পরকে দায়ী করেন। সার্বিক বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. বাকির হোসেন বলেন, রোগ পরীক্ষার ভারী যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়। কিন্তু এগুলো চালানোর দক্ষ জনবল দেওয়া হয় না। অদক্ষ টেকনিশিয়ানরা চালানোয় মেশিনগুলোতে সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হলে সেটি মেরামত করার কোনো লোক নেই। দিনের পর দিন অকেজো থাকায় মেশিনগুলো কার্যকারিতা হারাচ্ছে। বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার পদায়ন করা না হলে এই মেশিন দিয়ে রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ২০১০ সালে হাসপাতাল ১ হাজার শয্যায় উন্নীত করা হলেও সে অনুযায়ী জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়নি। উপরন্তু ৫০০ শয্যা হাসপাতালের জনবল কাঠামোতেও ডাক্তার এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট রয়েছে। জনবল সংকট দূর না করলে রোগীদের অভাব-অভিযোগ কমবে না।

সর্বশেষ খবর