বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমি

ফারুক আল শারাহ, লাকসাম

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে কালের সাক্ষী কুমিল্লার লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে এ বধ্যভূমি অন্যতম একটি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১০ হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি অবহেলিত। জানা যায়, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বৃহত্তর লাকসামের গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে লালমাই-সোনাইমুড়ি সড়কে আধিপত্য বিস্তার এবং নদীবন্দর চাঁদপুরের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পাকিস্তান বাহিনীকে স্থলপথে লাকসামে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়েছিল। ’৭১ সালের ২৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লাকসাম পাইলট হাই স্কুল মাঠে বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন নাঙ্গলকোটের নজির আহমেদ ভূঁইয়া। ৬ এপ্রিল আজগরা বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর বোমারু বিমানের আক্রমণে ২৬ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। রক্তাক্ত আজগরা বাজার তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন হাজী আলতাফ আলী। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তান আর্মি চূড়ান্তভাবে লাকসাম দখলের পর প্রধান সড়ক ও রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বিহারি আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন চাঁদপুর টোব্যাকো কোম্পানিকে বেছে নেয় যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে।

যা ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ নামে পরিচিত ছিল। শুধু তাই নয়, ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ সুরক্ষায় কয়েক কিলোমিটার এলাকাব্যাপী খনন করা হয়েছিল পরিখা। এখান থেকেই বিভিন্ন স্থানে পাক-সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অধীনে খোলা হতো ছোট ছোট ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ছিল, হরিকোটের ব্রিজ, নাথেরপেটুয়া বাজার, লাকসাম কলেজ, খিলাবাজার, হাসনাবাদ বাজার, পশ্চিমগাঁও দরগা এলাকা, মুদাফরগঞ্জ বাজার। চৌদ্দগ্রামের সীমন্ত পর্যন্ত ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া, এখান থেকেই কুমিল্লা দক্ষিণাঞ্চল, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনীসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা নিয়ন্ত্রণ করত। ব্রিটিশ আমল থেকেই লাকসাম রেলওয়ে জংশনটি সুপরিচিত। তখন ট্রেনযোগে এসে বিভিন্ন এলাকার যাত্রীরা লাকসাম জংশন নামতেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ-নিরপরাধ পুরুষ ও নারী যাত্রীদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে হত্যা করে এ বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দিত। ‘মিনি ক্যান্টনমেন্টে’ ইলেকট্রিক শক দিয়ে লাশ নিয়ে আসা হতো এখানে মাটিচাপা দেওয়ার জন্য। যাদের দিয়ে দিনের বেলা গর্ত খোঁড়ানো হতো, তাদেরই রাতে ব্রাশফায়ার করে এই গর্তে ফেলা হতো। কারখানা ভবনটির ভিতর ও বাইরে মোট ৩১টি বাঙ্কারে প্রচুর পরিমাণে গোলাবারুদ মজুদ ছিল। একদিকে গণহত্যা-নির্যাতন, অপরদিকে এই কারখানা থেকে পুরো অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন ছিল পাকিস্তান বাহিনীর কাজ। লাকসাম বেলতলী বধ্যভূমিতে এমনভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল যা হৃদয়স্পর্শী। এ স্থানটিকে ঘিরে বৃহত্তর লাকসামের মানুষের মাঝে ছিল অজানা আতঙ্ক। স্থানীয়দের কেউ কেউ এখানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল। আবার কেউ কেউ তাদেরকে এলাকা ছাড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিল। ওই সময় এ জনপদের মানুষ আতঙ্কিত হলেও যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে যাননি। তারা সংঘটিত হয়ে লাকসামকে পাক হানাদারমুক্ত করার প্রত্যয়ে গর্জে ওঠে। তাদের প্রতিরোধ করতে বৃহত্তর লাকসামে ৪টি সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়। ঐক্যবদ্ধ জনতার দুর্বার প্রতিরোধে সফলতা আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বৃহত্তর লাকসামের বিভিন্ন এলাকা থেকে হানাদারমুক্ত হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ড লাকসামে অবস্থানরত দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তীতে মিত্র বাহিনী লাকসাম জংশন ও সিগারেট ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে পাক সেনাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। দুই দিন ধরে প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাক বাহিনী লাকসাম থেকে পশ্চিম দিকে মুদাফরগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালাতে থাকে। পালানোর সময় মিত্র বাহিনী চুনাতি নামক গ্রামে এবং মুক্তিবাহিনী শ্রীয়াং ও বাংলাইশে পাক বাহিনীকে মুখোমুখি আক্রমণ করে। এতে পাকবাহিনীর অসংখ্য প্রাণহানিসহ অনেক পাক হানাদার সেনা বন্দী হয়। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভোরে যৌথ বাহিনী লাকসামকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি অবহেলিত। স্মৃতিসৌধ এলাকায় সীমানা প্রাচীর থাকলেও নেই গেট। এতে এলাকাটি গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। দ্রুত স্মৃতিসৌধের সীমানা প্রাচীরের গেট নির্মাণের দাবি জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বধ্যভূমির মধ্যে লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন সরকার। এ লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন তৈরি করে প্রেরণের জন্য চিঠি পাঠানো হলে তিনি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে স্থানটি সংরক্ষণের প্রস্তাবনা প্রেরণ করেন। লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল বারী মজুমদার জানান, লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমি স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন। এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সাধারণ মানুষসহ ট্রেনের যাত্রীদের পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা শেষে মাটিচাপা দিয়েছে। এখানে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল বলে তিনি জানান। লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম সাইফুল আলম বলেন, সরকার লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রস্তাবনা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর