রবিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বিপর্যয়ে দুবলার চরের শুঁটকিপল্লী

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

বিপর্যয়ে দুবলার চরের শুঁটকিপল্লী

বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবন উপকূলে কাক্সিক্ষত মাছ পাচ্ছেন না দুবলার চরের শুঁটকিপল্লীর জেলেরা। ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবাধে মাছ ধরায় এ অবস্থার সৃষ্টি। খালি পড়ে আছে শুঁটকি তৈরির হাজার হাজার মাচান। কেনাবেচা কমে গেছে আলোর কোলের দোকানপাটেও। হাসি নেই জেলে, শ্রমিক, বহদ্দার, ব্যবসায়ী কারও মুখেই। ফলে এ বছর চরম বিপর্যয়ের মুখে শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার শুঁটকিপল্লীর জেলেরা। ভারতীয় জেলেদের কারণে কর্মচঞ্চলতা নেই শুঁটকি উৎপাদনকারী আলোর কোল, নারকেলবাড়িয়া, মাঝের কিল্লা, মেহের আলী ও শেলার চরে। হতাশায় ধুঁকছে ওই পাঁচ চরে শুটকি প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রায় ২০ হাজার মানুষ। কোটি কোটি টাকা লোকসানে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায়েও ঘাটতির আশঙ্কা করছে বন বিভাগ। গতকাল শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন শুঁটকি উৎপাদনকারী চরগুলো ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে, বহদ্দার, ব্যবসায়ী, বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। দুবলার আলোর কোলের শুঁটকি প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত সাতক্ষীরার আশাশুনির জেলে আতিয়ার রহমান, হামিদ মোড়ল এবং বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার আক্কাস শেখ ও প্রদীপ মিস্ত্রি জানান, তারা প্রত্যেকে ১৫-২০ বছর ধরে শুঁটকি এ পেশায় জড়িত। কিন্তু এবারের মতো এতটা কম মাছ আগে কখনো দেখেননি। এ বছর জেলে-মহাজন কারও মনেই আনন্দ নেই। আলোর কোলে জেলেদের অস্থায়ী নিউমার্কেটের মেসার্স হাবিব অ্যান্ড হবিবা স্টোরের মালিক হাফিজুর রহমান জানান, তার দোকানে চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন মাল বিক্রি হয়। এ পর্যন্ত জেলে-মহাজনদের কাছে প্রায় ৪ লাখ টাকা বাকি পড়েছে। সাগরে মাছ না পড়ায় বাকি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না। মাঝের কিল্লার শুঁটকি ব্যবসায়ী চট্টগ্রামের জাহিদ বহদ্দার জানান, গত বছর মাঝের কিল্লা চরে চট্টগ্রামের সাতজন বহদ্দার ছিলেন। কিন্তু এবার এসেছেন মাত্র দুজন। এখন পর্যন্ত তার প্রায় কোটি টাকা এবং পাশের আবু বহদ্দারও প্রায় ৮০ লাখ টাকা লোকসানে রয়েছেন। ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ছেঁকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের ম্যানেজার ফরিদ আহম্মেদ বলেন, ‘ভারতের জেলেরা আমাদের এক নম্বর ফেয়ারওয়ে বয়ার কাছাকাছি চলে আসে; যা দুবলার চর থেকে মাত্র ৫-৬ নটিক্যাল মাইল দূরে। তাদের ট্রলিংয়ে জিপিআরএস ও ফিশ ফাইন্ডার রয়েছে। তা দিয়ে দিক নির্ণয় ও মাছের অবস্থান শনাক্ত করে ঘন ফাঁসের নেট দিয়ে আমাদের সীমানার মাছ ছেঁকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা লাক্ষা, ছুরি, রূপচাঁদা, লইট্টাসহ দামি মাছ পাচ্ছি না। আমাদের কোম্পানি এবার কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা লোকসানে পড়বে।’ দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি কামাল আহমেদ বলেন, ‘ভারতের অগণিত ফিশিং ট্রলার নিয়ে জেলেরা আমাদের মৎস্যসম্পদ লুটে নিচ্ছে। বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতের জেলেদের বিচরণ বন্ধ করতে না পারলে ঐতিহ্যবাহী দুবলার শুঁটকি উৎপাদন অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে।’ দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রহ্লাদচন্দ্র রায় বলেন, ‘গত চার গোনে (অমাবস্যা-পূর্ণিমার হিসাবে) জেলেরা কোনো মাছ পায়নি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। পাশাপাশি জেলে-মহাজনরাও চরম ক্ষতির মুখে পড়বেন।’ সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমাদের জলসীমায় ভারতীয় জেলেদের মাছ ধরার বিষয়টি শুনেছি। এ ব্যাপারে কোস্টগার্ডকে অবহিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার বন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ ভারতের জেলেদের বাংলাদেশের সীমায় ঢুকে মাছ ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা আবু মুসা (এবি) বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটলে দুবলা কোস্টগার্ড স্টেশনের সদস্যরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২২ ডিসেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমায় অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে “মঙ্গলচন্ডী-৭” নামে একটি ফিশিং ট্রলারসহ ১৬ ভারতীয় জেলেকে গ্রেফতার করে কোস্টগার্ড। মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ সীমার ১০.২ নটিকাল মাইল ভিতরে একটি ভারতীয় ফিশিংকে মাছ ধরতে দেখেন। টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে ধাওয়া দিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।’ 

সর্বশেষ খবর