মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মুখ থুবড়ে পড়েছে হাসকিং মিল

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

মুখ থুবড়ে পড়েছে হাসকিং মিল

শস্যভাণ্ডার খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁয় একসময় হাসকিং মিলগুলো প্রাণবন্ত ছিল। কিন্তু অটোমেটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনেক চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেকে টিকতে না পেরে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। কেউ কেউ চাতালগুলোতে চালের পরিবর্তে ধানের চিটা থেকে গুঁড়া তৈরি করছেন। আর শ্রমিকরা জীবিকার তাগিদে বদলেছেন পেশা। জেলায় প্রায় ১২০০ হাসকিং মিল ছিল। যেখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল। বর্তমানে এসব হাসকিং মিলের পাশাপাশি ৫৫টি অটোমেটিক রাইস মিল চালু হয়েছে। অটোমেটিক রাইস মিলগুলো পুরোদমে চালু থাকলেও হাসকিং মিলগুলোর প্রায় অর্ধেকই এখন বন্ধ। আর যেসব মিল টিকে রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও নাজুক। নারী শ্রমিক কোহিনূর বেগম জানান, চাতালে ২০০ মণ ধান ভিজানো ও শুকানো থেকে শুরু করে ভাঙানো পর্যন্ত পারিশ্রমিক হিসেবে ৬০০ টাকা এবং ৪৫ কেজি চাল দেওয়া হতো। জনপ্রতি ভাগে ১০০ টাকা ও সাড়ে ৭ কেজি করে চাল পাওয়া যায়। মাসে ৩-৪টা চাতাল উঠে। পরিশ্রম বেশি হয় কিন্তু সে তুলনায় পারিশ্রমিক পাই না। যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চলা কষ্টকর হয়ে ওঠে। একসময় অনেক মানুষ কাজ করত। অনেক চালকল বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন কৃষিকাজ, ভ্যান চালানো কেউবা ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁপানিয়া এলাকার কফিল উদ্দিন চালকলের মালিক কফিল উদ্দিন বলেন, প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে চাতালের সঙ্গে জড়িত। সে সময় মিলে ১৫-১৮ জন শ্রমিক কাজ করতেন। গত ছয় বছর থেকে চাতাল বন্ধ রয়েছে। চাল উৎপাদনের পরিবর্তে তিনি এখন ধানের চিটা সংগ্রহ করে গুঁড়া ভাঙানোর কাজে মিল ব্যবহার করছেন।

সামিয়া চালকলের মালিক মোতালেব হোসেন বলেন, ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে প্রায় ৭-১২ দিন সময় লেগে যায়। আর অটোমেটিক রাইস মিলে ১-২ দিনের মধ্যে চাল উৎপাদন করে বাজারজাত করে এবং তারা দাম পায়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। অটোমেটিক রাইস মিলের কারণে আমরা টিকতে পারছি না। বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের সুবিধা পায় না। জেলা অটোসাটার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোজাফফর হোসেন বলেন, অনেক চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। গত ১০-১৫ বছর আগে যে পারিশ্রমিক দেওয়া হতো এখনো সেই মজুরি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। পারিশ্রমিক বাড়াতে মালিকদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দুই বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। মেসার্স ফারিহা রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী শেখ ফরিদ উদ্দিন বলেন, অটোরাইস মিলে ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন শ্রমিক ৩০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করতে পারে। সেখানে হাসকিং মিলে এক সপ্তাহে প্রায় ১৫ জন শ্রমিক ৩০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করতে পারে। একসময় প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অটোরাইস মিল আসার পর মানুষ বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। মানুষের দৈন্য বেড়েছে। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে। অটোমেটিক রাইস মিলে চাল উৎপাদন করতে বেশি গরম করতে হয়। ওই চালের ভাত রান্নার পর দীর্ঘ সময় ভালো থাকে। কিন্তু হাসকিং মিলের চালের ভাত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু হলেও দীর্ঘ সময় ভালো থাকে না। ছোট মিলের জন্য সরকার কম পরিমাণ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে যেন হাসকিং মিল মালিকরা সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে।

সর্বশেষ খবর