রবিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ফসলি জমির মাটি লুটের মহোৎসব

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

ফসলি জমির মাটি লুটের মহোৎসব

বগুড়ার শেরপুরে ফসলি জমি কেটে মাটি ও বালু লুটের মহোৎসব চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীসহ সব মহলকে ম্যানেজ করে মাটি-বালু লুটের প্রতিযোগিতায় মেতেছেন একাধিক প্রভাবশালী মহল। স্থানীয় প্রশাসন বারবার অভিযান চালিয়েও থামাতে পারছেন না। বরং তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দিনে-রাতে সমানতালে ড্রেজার ও খননযন্ত্রের মাধ্যমে ফসলি জমির বুক চিরে অবৈধভাবে মাটি-বালু উত্তোলন করে চলেছেন। এতে করে শত শত বিঘা কৃষি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। ফলে কমতে শুরু করেছে খাদ্য উদ্বৃত্ত এই আবাদি জমির পরিমাণ। এদিকে কৃষি জমি সর্বনাশ করে অবাধে কাটা মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়। অতিরিক্ত মাটি পরিবহন আর ওভারলোড ড্রাম ট্রাক ও ট্রাক্টর চলাচলের ফলে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। এ ছাড়া ধুলা-বালিতে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সাধারণ মানুষও অতিষ্ঠ। জানা যায়, এই উপজেলার দশটি ইউনিয়নে অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি জায়গায় খননযন্ত্রের মাধ্যমে ফসলি জমি কেটে মাটি-বালু লুটে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আরও আট থেকে ১০টি জায়গায় জলাশয় সংস্কারের নামে মাটি কেটে বিক্রির পাশাপাশি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এই কাজে জড়িত শতাধিক প্রভাবশালী মহল। এদের রাজনৈতিক পদ-পদবি না থাকলেও সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থক। তাই প্রশাসনসহ সব মহলকে ম্যানেজ করতে তেমন বেগ পেতে হয় না তাদের। প্রভাবশালী এই দলটি প্রথমে বিশাল মাঠের মাঝখানে কমদামে জমি কিনে থাকেন। এরপর সেই ফসলি জমি থেকে শুরু করেন মাটি বিক্রি। সেই সঙ্গে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রাতের আঁধারে তোলা হয় বালু। তৈরি হয় বিশাল আকারের গর্ত। স্বাভাবিক কারণেই আশপাশের জমি ভাঙতে শুরু করে। এরপর ভয় দেখিয়ে ওইসব ফসলি জমি কিনে শুরু করা হয় মাটি-বালু উত্তোলন। এভাবে মাটি-বালুর লোভে কৃষি জমির সর্বনাশ করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী কৃষক আবদুল হামিদ বলেন, আমার ছয় বিঘা জমি কিনে মাটি-বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী মহল। এ কারণে সেখানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আমার দুই বিঘা ফসলি জমিও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ ছাড়া সড়কের পাশের জমিগুলোতেও ট্রাক থেকে মাটি-বালু পড়ে সবজি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। নিষেধ করলে জমি বিক্রি করার জন্য চাপ প্রয়োগ দেন। এমনকি বেশি বাড়াবাড়ি না করার জন্যও এলাকার চিহ্নিত ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। তাই ভিটেমাটি নিঃশেষ হয়ে গেলেও তাদের মতো গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে করার কিছুই নেই বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

খানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, সরকারি আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে ফসলি জমি কেটে অবাধে মাটি-বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এসব মাটি পরিবহনের ওভারলোড ট্রাকের কারণে গ্রামীণ পাকা সড়ক নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের জানানোর পর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মাটি-বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর দু-এক দিন বন্ধ থাকলেও আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের। প্রশাসনও নির্বিকার। কোনো বাধাই মানছেন না তারা। অবাধে মাটি-বালু উত্তোলন করায় কৃষি জমি ও পাকা সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মাসুদ আলম বলেন, ফসলি জমির মাটি কাটার কোনো সুযোগ নেই। জমির উপরিভাগের মাটি কাটার কারণে উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়। আর বালু উত্তোলন করা হলে ধসে গিয়ে বড় বড় গর্ত হয়ে বিনষ্ট হবে। তাই যে কোনো মূল্যে কৃষি জমি রক্ষা করতে হবে। কারণ কৃষি জমি কমে গেলে খাদ্য উদ্বৃত্ত এই উপজেলায় খাদ্যের সংকট দেখা দেবে। বিষয়টি সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী সেখ বলেন, অনুমতি ছাড়া জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আইন অনুযায়ী দন্ডনীয় অপরাধ। তাই ফসলি জমি কেটে মাটি-বালু উত্তোলন করার খবর পেয়েই একাধিকবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। জরিমানাসহ বেশ কয়েকটি খননযন্ত্রও জব্দ করা হয়েছে। এই অভিযান চলমান রয়েছে। এখানে অবৈধভাবে মাটি-বালু উত্তোলন করার কোনো সুযোগ নেই।

তাই খোঁজখবর নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ মাটি-বালু উত্তোলন সব বন্ধ করে দেওয়া হবে দাবি করেন এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর