সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সংকটে পাদুকাশিল্প

লকডাউনে ২০ কোটি টাকার ক্ষতি

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সংকটে পাদুকাশিল্প

রমজান মাসকে পাদুকা শিল্পের মূল মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই মাসে কারখানাগুলোতে পুরোদমে চলে জুতা তৈরি ও বাজারজাতকরণের কাজ। কিন্তু এবার ভরা মৌসুমেও সংকটে ভুগছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকাশিল্প। গেল বছরের মতো এবারও করোনাভাইরাসের থাবায় বিপর্যস্ত সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি। সরকারি নির্দেশনায় লকডাউনের মধ্যে কারখানা খোলা রেখে এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের। সেজন্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে বিপণিবিতানগুলো খুলে দেওয়ার দাবি তাদের। জানা গেছে, বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫০ পাদুকা কারখানা সচল রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬টি কারখানায় জুতা  তৈরি হচ্ছে মেশিনের সাহায্যে। আর বাকিগুলোতে জুতা তৈরি হয় কারিগরদের হাতে। ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দামের জুতা তৈরি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারখানাগুলোতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে জুতা নিয়ে যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক পাদুকা কারখানাগুলোতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু এত মানুষের কর্মসংস্থান করা শিল্পটি মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভরা মৌসুমেও মাথায় হাত পড়েছে ব্যবসায়ীদের। লকডাউনের কারণে জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালেরও দাম বাড়ায় উভয়সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া চলমান লকডাউনের কারণে জুতা নেওয়ার জন্য পাইকাররাও আসতে পারছেন না কারখানাগুলোতে। মূলত পাদুকাশিল্পের দুর্দিন শুরু হয় গেল বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের কারণে তখন সরকারি নির্দেশনায় কারখানাগুলো বন্ধ করে দেন মালিকরা। পরবর্তীতে ওই বছরের জুনে কারখানাগুলো খুললেও করোনার ধকল কাটছিল না। সব শ্রমিক কাজে না আসায় এবং বাজারে চাহিদা কম থাকায় জুতার উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। ফলে গত বছরের মৌসুম ধরতে পারেননি কারখানা মালিকরা। এরপর শীত মৌসুমেও অলস সময় পার করেছেন পাদুকা কারখানার শ্রমিকরা। কারণ শীতে পরার মতো কোনো জুতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারখানাগুলোতে তৈরি হয় না। এর ফলে পাদুকা শিল্পের সুদিনের জন্য গ্রীষ্মকালের অপেক্ষা করতে থাকেন কারখানা মালিকরা। কিন্তু এই দুর্দিনেও কারখানার ভাড়া ও স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ সব ব্যয়ই মেটাতে হয়েছে মালিকদের। এতে করে গেল বছর পাদুকা শিল্পে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাদুকা শিল্পে নতুন করে সংকট দেখা দেয় চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে। মহামারী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনের কারণে দোকানপাট বন্ধ থাকায় উৎপাদিত জুতা বাজারজাত করা যাচ্ছে না। অনেক কারখানায় উৎপাদিত কয়েক কোটি টাকার জুতা পড়ে রয়েছে। এ ছাড়া জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দামও বেড়েছে। ১৭০ টাকা লিটারের কেমিক্যাল এখন কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকায়। আর লকডাউনের আগে একগজ ফোমের দাম ছিল ৩৮০-৩৯০ টাকা। সেই ফোম এখন সাড়ে ৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য কাঁচামালের দামও বেড়েছে। কিছু কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে হয়। কিন্তু ফ্লাইট বন্ধ থাকার কারণে সেগুলো আনা যাচ্ছে না। এতে করে আমদানিকারকরা কাঁচামালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই পাদুকা ব্যবসা।

এই সময়ে বড় কারখানাগুলো গড়ে ১ থেকে দেড় কোটি টাকা মূল্যের জুতা বিক্রি করে থাকে। আর ছোট কারখানাগুলো বিক্রি করে ২০-২৫ লাখ টাকার জুতা। গেল বছর করোনাভাইরাসের কারণে দুই ঈদে কোনো ব্যবসা হয়নি। এবারের ঈদ মৌসুমে ব্যবসা করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা থাকলেও তা আর হচ্ছে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পীরবাড়ি এলাকার এক্টিভ পিউ ফুটওয়্যারের ফিটিংম্যান মো. রফিক জানান, তিনি ২৮-২৯ বছর ধরে পাদুকা কারখানায় কাজ করছেন। এই কাজ করে মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হয় তার। এই টাকা দিয়েই স্ত্রী ও চার সন্তানের সংসার চলে। আগে রোজার মাস এলে সারারাত কাজ করতেন। কিন্তু গত বছর থেকে কারখানায় আগের মতো কাজ নেই। এর ফলে রোজার সময় বাড়তি কাজ করে যে টাকাগুলো পেতেন, সেগুলো এবারও পাবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। সেভেন স্টার ফুটওয়্যারের পরিচালক মো. হানিফ জানান, আমার কারখানায় ৫০-৬০ লাখ টাকার জুতা পড়ে আছে। এগুলো বাজারজাত করা যাচ্ছে না। সরকার লকডাউনে দোকানপাট বন্ধ রেখেছে, অথচ কারখানা খোলা রাখতে বলেছে। কিন্তু দোকানপাট বন্ধ থাকায় কারখানা খোলা রেখে আমাদের আরও লোকসান হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি কাজী শফিউদ্দিন বলেন, বিদেশি জুতার কারণে বাজারে এমনিতেই আমাদের দেশীয় জুতার চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পাদুকা শিল্পে নতুন সংকট তৈরি করেছে করোনাভাইরাস।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর