সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

পানি কমলেও বেড়েছে ভাঙন সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

দেশের বিভিন্ন জেলার নদ-নদীতে আকস্মিক বন্যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ। বাঁধে ও খোলা আকাশের নিচে ঝুপড়ি তুলে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে

প্রতিদিন ডেস্ক

পানি কমলেও বেড়েছে ভাঙন সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

সিরাজগঞ্জে পানি কমলেও ভাঙন কমছে না। যমুনার করাল গ্রাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ। বাঁধে ও খোলা আকাশের নিচে ঝুপড়ি তুলে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। গাছপালা নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় পরিবেশ হারাচ্ছে ভারসাম্য। রংপুরের পীরগাছায় তিস্তার ভাঙনের মুখে একমাত্র স্কুল। এ ছাড়া চলতি বছরে অর্ধশত বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেক মানুষ। সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আবদুস সামাদ সায়েম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাতে জানান, যমুনা নদী সিরাজগঞ্জ অংশের পশ্চিম তীর ৮০ কিলোমিটার আর পূর্ব তীরে প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে পশ্চিম তীরে ৩৫ কিলোমিটার ও পূর্ব তীরে প্রায় ৬ কিলোমিটার রক্ষিত রয়েছে। বাকি অরক্ষিত স্থানগুলোর মধ্যে চৌহালী, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও সিরাজগঞ্জ সদরের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতি বছর বন্যার শুরু থেকেই তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই তীরে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। পূর্ব তীরের চৌহালীর পাঁচ কিলোমিটার এলাকা বাঘুটিয়া ও খাসপুখুরিয়ায় ভাঙনরোধে গত বছর সাড়ে ৪ কোটি টাকার জিওব্যাগ ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। এ বছর ভাঙনের শুরুতেই সেই জিওব্যাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানেও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন বিলীন হচ্ছে বসতভিটা। পশ্চিম তীরের এনায়েতপুরের ৬ কিলোমিটার এলাকায় একদিকে জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে ভাঙনে জিওব্যাগসহ সব বিলীন হচ্ছে।

১৫ দিনের ব্যবধানে এনায়েতপুরের জালালপুর, আড়কান্দিসহ আটটি গ্রাম এবং চৌহালীর বাঘুটিয়া ও খাসপুখুরিয়ার অন্তত ১৫টি গ্রামের অন্তত পাঁচ শতাধিক বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে ভাঙনকবলিতরা। ভাঙনের কারণে এক সময়ের জমিদার মুহূর্তে ফকির হয়েছে। বাঘুটিয়ার এলাকার ভাঙনকবলিতরা বলছেন, এ বছর ভাঙনরোধে পাউবো অর্ধকোটি টাকার জিওব্যাগ ফেলানোর প্রকল্প নেয়। নিম্নমানের কাজ হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়রা তা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, সরকার ভাঙনরোধে অর্থ বরাদ্দ দিলেও তা সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়ায় ভাঙনও কমছে না। স্থানীয় ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম জানান, ভাঙনকবলিতরা দুর্বিষহ অবস্থায় জীবনযাপন করছে। ভাঙনরোধে অস্থায়ী জিওব্যাগ ফেলে সরকারের কোটি কোটি টাকা জলে ফেলা হচ্ছে। বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুস ছামাদ সিকদার, খাসপুখুরিয়া ইউনিয়নের আবু দাউদ সরকার জানান, যে হারে ভাঙছে, দ্রুত রোধ করা না হলে দুটি ইউনিয়ন মানচিত্রে ঠাঁই পাবে, বাস্তবে থাকবে না। চৌহালী অংশের দায়িত্বে থাকা টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, যমুনার তীর সংরক্ষণ কাজে নিম্নমানের কোনো উপকরণ ব্যবহার করা যাবে না। জিওব্যাগ নিম্নমানের হওয়ায় কাজ বন্ধ করা হয়েছিল। গুণগত মানের ব্যাপারে করা নির্দেশনা দিয়ে উন্নতমানের জিওব্যাগ ব্যবহার করে গতকাল থেকে পুনরায় ডাম্পিং কাজ শুরু করা হয়েছে। তিনি জানান, ভাঙনরোধে ৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন জানান, যমুনার পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১ সেমি কমেছে। পানির লেভেল ১২.৪০ সেমি রয়েছে। তবে পানি কমলেও ভাঙন কমছে না। অরক্ষিত স্থানে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে।

রংপুর :  রংপুর থেকে নজরুল মৃধা জানান, জেলার পীরগাছার চর দক্ষিণ গাবুরা গ্রামে ভাঙনের মুখে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে একমাত্র চর দক্ষিণ গাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। নদী থেকে মাত্র ১৫ মিটার দূরে স্কুলটি রক্ষায় শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা প্রশাসন, স্কুলের শিক্ষক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা। ফেলা হচ্ছে জিওব্যাগ। চলতি বছরেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ওই গ্রামের ৫০টি বসতভিটা। ভাঙনের ফলে এসব বাড়ির লোকজন এখন আশ্রয়হীন। জানা গেছে, উপজেলা ছাওলা ইউনিয়নের চর দক্ষিণ গাবুরা গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে  গেছে  তিস্তা নদী। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় চর দক্ষিণ গাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি ২০১৪ সালে একবার ভাঙনের কবলে পড়ে বর্তমান স্থানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে পিইডিপি-৩ প্রকল্পের অর্থায়নে একটি আধুনিক ভবন গড়ে তোলা হয়। চলতি বছরেই ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ৫০টি বাড়ি। আর মাত্র কয়েকটি বসতবাড়ি ও একমাত্র স্কুলটি ভেঙে গেলেই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে গ্রামটি। এলাকাবাসীর দাবি, গত বছরও বিদ্যালয়টি ভাঙন ঝুঁঁকিতে পড়েছিল। তখন ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

নদীভাঙনে শিকার খয়বার আলী, তালেব মিয়া, আমজাদ হোসেন, মাজেদ আলী বলেন, সময়মতো উদ্যোগ নিলে বিদ্যালয়ের আশপাশের বাড়িঘরও রক্ষা পেত। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকরাম হোসেন বলেন, নদী একেবারে স্কুলের কিনারে চলে এসেছে। স্কুলটি রক্ষায় কাজ করা হচ্ছে। আরও ৫ হাজার জিওব্যাগ ফেলা দরকার। তাহলে হয়তো স্কুলটি রক্ষা করা যাবে।

পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ শামসুল আরেফীন বলেন, স্কুলটি রক্ষায় জোর চেষ্টা চলছে। জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গতকাল সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

বগুড়া : নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রহমান টুলু জানান, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার পর আবারও কমতে শুরু করেছে। শনিবার বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার প্রায় ৭২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর আগে শুক্রবার বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি কিছুটা কমতে থাকায় যমুনা নদী পাড়ের মানুষ স্বস্তিত রয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার পরশুরাম জানিয়েছেন, শুক্রবার পর্যন্ত যমুনা নদীতে পানির উচ্চতা ছিল ১৬.০৩ সেন্টিমিটার, যা বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে শনিবার দুপুরে পানির উচ্চতা কমে ১৫.৯৮ সেন্টিমিটার দাঁড়ায়। সে হিসাবে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার প্রায় ৭২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নেত্রকোনা : জেলা প্রতিনিধি আলপনা বেগম জানান, হাওরাঞ্চলের খালিয়াজুরীতে বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ধনু নদীর পানি কমে গতকাল ১৪ সেন্টিমিটারে নেমেছে। এদিকে বেড়েছে হাওরের পানি। এ ছাড়া জেলার কংশ, মগড়া ও সোমেশ্বরী নদীর পানি রয়েছে বিপৎসীমার নিচে। নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত জানান, খালিয়াজুরী বাজার পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার থেকে নেমে ১৪ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সীমান্ত উপজেলা দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর বিজয়পুর পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে ৪২৬, দুর্গাপুর পয়েন্টে ৩৪১, কলমাকান্দা উপজেলা কংশ নদীর পয়েন্টে ৩৮ ও পূর্বধলার জারিয়া পয়েন্টে ১৪৭ সেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর