শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

কুয়াকাটায় সুনসান নীরবতা

লকডাউনের কারণে বন্ধ হোটেল-মোটেল। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী

সঞ্জয় দাস লিটু, পটুয়াখালী

কুয়াকাটায় সুনসান নীরবতা

চিরচেনা সমুদ্রসৈকত সাগরকন্যা কুয়াকাটায় নেই পর্যটকের কোলাহল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে সারা দেশে চলছে লকডাউন। তবে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক দিনের জন্য লকডাউন শিথিল করা হলেও পর্যটন কেন্দ্রগুলো রয়েছে এর বাইরে। তাই ভ্রমণে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। বিগত দিনগুলোয় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার আগে-পরে সরকারি ছুটিতে যখন দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের পদচারণে দিনরাত মুখরিত থাকত ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বেলাভূমির কুয়াকাটা, ঠিক সে মুহুর্তে পর্যটকশূন্য সাগরকন্যা কুয়াকাটা। চিরচেনা সমুদ্রসৈকতে নেই পর্যটকের কোলাহল। এমন নীরব নিস্তব্ধ কুয়াকাটা কখনই দেখেনি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। এ যেন এক অচেনা কুয়াকাটা। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় বেকার কয়েক হাজার কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারী। হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকায় কয়েক মাস ধরে বেতনও বন্ধ। তাই ঈদ আনন্দও নেই তাদের। লোকসানে পড়েছেন মালিকরা। করোনাভাইরাসের কারণে শুরু থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটকনির্ভর ব্যবসায়ীরা- এমনটাই দাবি ব্যবসায়ী নেতাদের।

স্থানীয়রা জানান, একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য অবলোকন করা যায় এমন স্থান বিশে^র অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র পটুয়াখালীর সাগরকন্যা কুয়াকাটা। প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটায় পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় থাকে। গত বছরের মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন থাকায় দুই বছরে চারটি ঈদের আগে বা পরে কুয়াকাটার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। চিরচেনা কুয়াকাটা সমুদ্র এখন স্থানীয়দের কাছেই অচেনা লাগছে। জনমানবহীন এমন সমুদ্রসৈকত বিগত দুই যুগেও দেখেননি তারা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে পুলিশ ও প্রশাসনের কড়া নজরদারির কারণে পর্যটক আসছেন না, আশপাশের দু-চার জন মাঝেমধ্যে ঘুরতে আসছেন। ফলে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত বর্তমানে জনমানবহীন, সুনসান। তাই ঈদের পরও দেখা যায় না কোনো ভ্রমণপিপাসুকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত অবলোকন করতে। স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমীরা জানান, লকডাউনের কারণে পর্যটকশূন্যতায় কুয়াকাটার প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে তার স্বরূপ। যেখানে প্রকৃতি সেজেছে নিজস্বতায় এক মনোরম দৃশ্যে। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ আগে থেকেই পর্যটকের আনাগোনা বেড়ে যেত কুয়াকাটায়। আর ঈদের পর দিন থেকে কমপক্ষে এক সপ্তাহ পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। হোটেল-মোটেল শতভাগ বুকিং হয়ে যায় ঈদের এক মাস আগে। ব্যবসায়ীরা বিকিকিনিতে ব্যস্ত থাকেন দিনরাত। পর্যটকের চাহিদামাফিক পণ্য বিক্রিতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীরা হিমশিম খেতেন। এমনকি পর্যটকের দিনরাত আনাগোনায় খাবার হোটেলগুলোর মালিক-কর্মচারীরা নির্ঘুম রাত কাটান। রেস্তোরাঁয় বেচাকেনা চলে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। আর সেই কুয়াকাটা বর্তমানে পর্যটকশূন্য। এমনকি আশপাশ এলাকার লোকজনও তেমন একটা আসেন না ঘুরতে।

কুয়াকাটার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী এখন কর্মহীন। লোকসানে সর্বস্তরের ব্যবসায়ী। কয়েক মাস ধরে বেতন বন্ধ থাকায় ঈদ আনন্দ করতে পারেননি পর্যটনসংশ্লিষ্টরা। সৈকতের মোটরবাইক চালক মো. মুসা বলেন, ‘কুয়াকাটায় কোনো পর্যটক নেই। করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন থাকায় আমরা বেকার হয়ে পড়েছি। বিগত বছরগুলোয় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ছুটিতে এত পর্যটক আসত যে তাদের সেবা দিতে আমরা দিনরাত বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখাতাম। আমাদের আয়ও হতো ভালো। সেই কুয়াকাটা কেউই নেই। তাই আমাদের আয় একেবারেই বন্ধ। সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’ ফটোগ্রাফার মামুন মিয়া বলেন, ‘সৈকতে আমরা শতাধিক যুবক ক্যামেরা নিয়ে পর্যটকদের সঙ্গে থেকে বিভিন্নভাবে ছবি তুলে সেবা দিই। যারা ক্যামেরা নিয়ে আসতেন না তাদের চাহিদামতো ছবি তুলে দিয়ে ভালোই আয় করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের আয় বন্ধ। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে জানি না।’ জয় রেস্টুরেন্টের মালিক গণেশচন্দ্র দাস বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকায় কেউ ঘুরতে আসে না এখানে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। আর বিগত বছরগুলোয় ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটায় পর্যটকের ভিড়ে বেচাকেনা করতে ২০ জন কর্মচারীকে দিনরাত কাজ করতে হিমশিম খেতে হতো। এখন আমরা সবাই বেকার। তাই লোকসানের মধ্যেও কর্মচারীর ভরণপোষণ দিতে হয়। খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছি।’ স্থানীয় হোটেল-মোটেলের মালিক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘লকডাউনের কারণে ২৪ মার্চ থেকে পর্যটক আসা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন।

তাই সবকিছু বন্ধ থাকায় কুয়াকাটায় হোটেল ব্যবসায় ধস নেমেছে। আমাদের ম্যানেজারসহ প্রায় ১৫ জন কর্মচারী বেকার। তাদের ভরণপোষণ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এবারের ঈদে আনন্দ নেই কুয়াকাটার ব্যবসায়ীদের।’ কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েসনের সাধারণ সম্পাদক কুয়াকাটা গেস্টহাউসের স্বত্বাধিকারী আবদুল মোতালেব শরীফ বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কুয়াকাটার ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন। এখানে সব মিলিয়ে শতাধিক হোটেল-মোটেল রয়েছে যার সবই বন্ধ। মালিকদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মচারীদের বেতন দিতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে, অনেকে আবার বেতন দিতেও পারছেন না।’ ২০২০ সালের মার্চে করোনার শুরু থেকে ঈদের আগে-পরে পর্যটক না আসায় পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব ব্যবসায়ী অন্তত হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর