শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

তিস্তার ভাঙনে বিপন্ন উত্তরের জনপদ

এক মাসে দুটি মসজিদ, চারটি কাঁচা-পাকা রাস্তা একটি সেতু ও ১৩ একর জমি বিলীন

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

তিস্তার ভাঙনে বিপন্ন উত্তরের জনপদ

তিস্তার পানি কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। কিন্তু কমা-বাড়ার মাঝে থেমে নেই নদীর ভাঙন। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় গত এক মাসে তিস্তা গর্ভে চলে গেছে শতাধিক পরিবারের বসতভিটা, প্রায় ১৩ একর উর্বর আবাদি জমি, মসজিদ, সেতু, কাঁচাপাকা সড়ক। ভাঙনে শিকার অনেক পরিবারের মাথা গোঁজার মতো জমি নেই। তাই কেউ চলে যাচ্ছেন চরে। অনেকেই চালাঘর ফেলে রাখছেন ফাঁকা জমিতে। আছেন অন্যের বাড়িতে। দুমুঠো খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে অসহায় পরিবারগুলো। ভিটাহারা মানুষের কান্না হাহাকারে ভারী হচ্ছে তিস্তার পাড়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দেওয়া ভিজিএফের ১০ কেজি চালও জোটেনি অনেকের ভাগ্যে। এ অবস্থায় ঈদের আনন্দ ছিল না তিস্তার পাড়ে। কুটিরপাড় গ্রামের বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, ‘বাড়িঘর, ভিটা সউগ ভাঙি গেইছে। নদীর পারোত পড়ি আছি। ঈদোত ছওয়াপোওয়া চাইরটা খামো, তারই উপায় ছিল না।’ চরে এমনিতেই কোরবানি কম হয়। এবার আবাদি জমি ও বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় কারও সামর্থ্য নেই কোরবানি দেওয়ার। তাই এক টুকরা মাংস অনেকের পাতে পড়েনি তিস্তা পাড়ের নদী ভাঙা পরিবারগুলোর মাঝে। সরেজমিন দেখা গেছে, তিস্তা ব্রিজের পশ্চিমে রংপুরের সীমানায় অবস্থিত চর ইচলি থেকে নোহালি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নদীর পাড় ভাঙছে। ঘূর্ণিস্রোতের কারণে ভাঙন প্রলয়ঙ্করী হয়ে উঠেছে। গত এক মাসে লালমনিরহাটের শতাধিক পরিবার ভিটা হারিয়েছেন। গত এক বছরে সব মিলে ভিটাহারা পরিবারের সংখ্যা ৫ শতাধিক। গত এক মাসে ২টি মসজিদ, ৪টি কাঁচা-পাকা রাস্তা, একটি সেতু,  ইউড্রেন ও ১৩ একর জমি বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি স্কুল ও মসজিদ। প্রাথমিক স্কুলটি যে কোনো সময় চলে যেতে পারে নদীগর্ভে। স্কুল রক্ষার্থে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হলেও প্রবল স্রোতে তা কার্যকর হচ্ছে কমই। বরং নদী দ্রুতগতি বদল করে কুটিরপাড় স্পারকেই ঝুঁকিতে ফেলছে। এই স্পারটি গত বছরের মতো ভাঙলে ভাটিতে ৫-৬টি গ্রাম পড়বে ভয়ংকর ভাঙনের কবলে। এদিকে ভাঙনের কবলে পড়ে অনেক পরিবার চলে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। অনেকেই যাওয়ার মতো জায়গা না পেয়ে ফাঁকা জমিতে বাঁশের খুঁটির ওপর ঝুলিয়ে রেখেছে ঘরের চাল। উপায় না পেয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত আছেন। চর গোকুন্ডার নিয়ামত আলী নৌকায় ঘরের চালসহ মালামাল তুলে চলে যাচ্ছেন অন্যের জায়গায়। বলেন, ‘যাবার মতো জায়গা নাই। কোথায় যাই। আপাতত মানুষের জায়গায় যেতে হবে। তারপর আল্লাহ যা করেন করবেন। তিনি জানালেন, গত বছর কোরবানি দিয়েছেন। এবার সাধ্য হয়নি। ভাগ্যেও জোটেনি কোনো মাংস। তিস্তার পাড়ে বাস করেন অমেলা বেওয়া। তিস্তার ভয়ংকর গর্জনে রাত কাটে বিনিদ্রায়। অন্যত্র চলে যাবেন-কিন্তু আর্থিক সংকটে যেতে পারছেন না। অমেলা বলেন, ‘ট্যাকা নাই পয়সা নাই, কোথায় যাই। ভাঙন আতঙ্কিত তিস্তা পাড়ে ঈদের কোনো আমেজ ছিল না। অভাবের তাড়নায় তাদের দিন কাটছে অনাহারে অর্ধাহারে। স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারিভাবে নদী ভাঙা পরিবারের পুনর্বাসনে কার্যকর উদ্যোগ নেই। এ পর্যন্ত মাত্র ২০০টি পরিবার ২ হাজার করে টাকা ও শুকনো খাবার পেয়েছেন। এর বাইরে কিছু পরিবার ভিজিএফের চাল পেয়েছেন। কিন্তু এতে কাটছে না তাদের থিতু হওয়ার সংকট, ঘরে নেই ঈদের আমেজ। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, ভাঙনের শিকার  পরিবারকে নগদ অর্থ ও শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। বাকিদের তালিকার প্রণয়ন করে সহায়তা করা হবে। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ভাঙনের প্রকোপ বেশি। তবে ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। আশা করা যায় এতে ভাঙনে ক্ষতির পরিমাণ কমবে।

সর্বশেষ খবর