বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বন উজাড় রোধে নানা উদ্যোগ

মো. নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল

বন উজাড় রোধে নানা উদ্যোগ

বনজ সম্পদ উজাড় রোধ ও বন নির্ভর জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবিকা এবং বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে টাঙ্গাইল বন বিভাগ। তারই ধারাবাহিকতায় টেকসই বন ও জীবিকা সুফল প্রকল্প এগিয়ে চলছে। এতে বনের ভিতরে বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও অতিদরিদ্র ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে বন ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ এবং রক্ষিত এলাকার উন্নয়ন হবে। টাঙ্গাইল বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মধুপুর বন এলাকায় মুখপোড়া হনুমান, লালমুখ বানর, মায়া হরিণ, শজারু, বুনো শূকর, মেছো বাঘ, বনবিড়াল, খরগোশসহ ১৯০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছ। এদের মধ্যে ২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, মেঘ হু, মাছরাঙা, খয়ড়া গোছা পেঁচা, বুতুম পেঁচা, নিম পেঁচা, পানকৌরি, সাদা বগ, রাতকানা বগ, চিল, কাঠঠোকরা, মায়া ঘুঘু, হুদহুদ, সবুজ সুইচোরা, বনমোরগসহ ১৪০ প্রজাতির পাখি ও গুই সাপ, অজগর, তক্ষক, বেজি, ঘোখরাসহ ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ব্যাঙসহ নানা প্রজাতির উভয়চর প্রাণীও রয়েছে। প্রায় একশ বছর পূর্বে মধুপুর বনে হাতি, বাঘ, চিতা ও ময়ূরের মতো প্রাণীর বিচরণ ছিল। তথ্য বলছে, ১৮৬৮ থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত মধুপুর গড় থেকে ৪১৩টি হাতি শিকার করা হয়। ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ভাগ হয়ে টাঙ্গাইল বনবিভাগের সঙ্গে মধুপুরকে যোগ করার পর ওই সময়ে পশু ও বন্যপ্রাণীর খাবার উপভোগী গাছ চুরি করার কারণে কমতে থাকে। এতে করে বনের ভিতরে থাকা পশু পাখি ও সরীসৃপ প্রাণী কমতে থাকে। বন সংরক্ষণে বন উজাড় রোধ ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন ও পশুখাদ্য উপযোগী করার জন্য ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমিতে ঔষধিসহ পশুপাখির খাদ্য উপযোগী ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৫০০টি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, বগডুমুর, কটবেল, মহুয়া, অর্জন, ডুমুর, বন আলী, আমড়া, বন আম বেওয়া, চাপালিশ, জলপাই, শিমুল, বট, বুতুম, গান্দি গজারি ডায়না উল্লেখ্যযোগ্য। ২০১৮-১৯ সালে জাতীয় উদ্যানে ২০০ হেক্টর ও দোখলা রেঞ্জ এলাকায় ১০০ হেক্টর জমিতে তিন লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করা হয়।

২০১৯-২০ সালে জাতীয় উদ্যানে ১৯০ হেক্টর, দোখলা রেঞ্জে ১৩০ হেক্টর ও মধুপুর রেঞ্জের ৫ হেক্টর জমিতে ৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করা হয়। ২০২০-২১ সালে ধলাপাড়া রেঞ্জে ৭০ হেক্টর, হতেয়া রেঞ্জে ২৩৫ হেক্টর, বহেড়াতলী রেঞ্জে ১০৫ হেক্টর, জাতীয় উদ্যানে ১০৫ হেক্টর, দোখলা রেঞ্জে ১৫০ হেক্টর, মধুপুর রেঞ্জে ৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মোট ১১ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। প্রতিটি বাগান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৮ সদস্য বিশিষ্ট ফরেস্ট পোটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন কমিটি (এফপিসিসি) করা হয়েছে। এ ছাড়াও ফরেস্ট কনভারসেশন ভিলেজ কমিটি (এফসিবি) রয়েছে। অপরদিকে ৭০০ কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কারকে (সিএফডব্লিউ) ৫ শতাংশ সুধে ৫০ হাজার করে টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এদের প্রত্যেককে মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। শ্রমিক সর্দার মো. সোলায়মান উদ্দিন বলেন, আমার নেতৃত্বে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করে। আমাদের বেকারত্ব দূরের পাশাপাশি আমার সংসার ভালোই চলছে। আমরা ছাড়াও করোনায় যারা কর্মহীন ছিল তারাও এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছে। কমিউনিটি ফরেস্ট ওয়ার্কার আনিসুর রহমান বলেন, ২০০৩ সালে বিএনপি সরকার ঘোষণা দিয়েছিল বনের ভিতর কোনো আকাঠ থাকবে না। তারপর থেকে বন থেকে আকাঠ গাছ পাচার হতে থাকে। এতে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেওয়ায় এরা লোকালয়ে পেঁপে, আনারস বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা শুরু করে। তখন স্থানীয় লোকজন বন্যপ্রাণীদের মারা শুরু করে। এভাবে বন্যপ্রাণী কমতে থাকে। যেভাবে ঔষধিসহ বিভিন্ন গাছ রোপণ করা হয়েছে। এসব গাছের ফল ধরার পর বন্যপ্রাণীর খাদ্যের অভাব হবে। মধুপুর বন আবার পূর্বের মতো বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হবে। দোখলা রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল আহাদ বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। বন্যপ্রাণীর খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য শাল বাগানের ভিতরে ফাঁকে ফাঁকে ফল জাতীয় বৃক্ষ রোপণ করছি। এ বৃক্ষগুলোর ফল বন্যপ্রাণীর খাবার হবে। টাঙ্গাইল বিভাগীয় বনকর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, বন্য প্রাণীর আবাসস্থল বাড়ানোর জন্য যে সব গাছের ফল খায় ওইসব গাছকে গুরুত্ব দিয়ে সুফল প্রকল্পের আওতায় ১১ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। যেভাবে গাছগুলো বেড়ে উঠছে তাতে আগামী তিন চার বছরের মধ্যে রেজাল্ট পাওয়া শুরু করব। তখন দেখা যাবে বন্যপ্রাণী তার আবাসস্থল ফিরে পাবে। এতে বন্যপ্রাণী বনের ভিতরেই থাকবে। তখন লোকলয়ে গিয়ে বন্যপ্রাণী সাধারণ মানুষকে কোনো সমস্যা ও ক্ষতি করবে না। ঠিক মানুষও তখন বন্যপ্রাণীর কোনো ক্ষতি করবে না। জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বলেন, বন বিভাগের উদ্যোগে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য গাছ লাগানোসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন বিভাগকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বানরসহ বেশ কিছু বন্যপ্রাণীর খাদ্যের অভাবে ভুগছে সেইসব বন্যপ্রাণীর খাবারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। জেলার যেখানেই বন্যপ্রাণীর খাদ্যের অভাব দেখা দিবে সেখানেই সহায়তা দেওয়া হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা পেলে আমরা বাঁচব। আমরা সবাই প্রাকৃতিক পরিবেশে সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর