শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে জীবন-জীবিকা

উপকূলীয় উপজেলাগুলোর কৃষি জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত

মনিরুল ইসলাম মনি, সাতক্ষীরা

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে জীবন-জীবিকা

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলের জনপদ সাতক্ষীরার উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে। উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগরের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল নিমজ্জিত ও লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিসহ প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে এ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এখানকার মানবসম্পদ ও অর্থনীতি আজ হুমকির মুখে। নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে হাজার হাজার উপকূলবাসী বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছে। জানা গেছে, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ ও ২ এর অধীনে জেলায়  উপকূলীয়  বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডে-১ এর আওতায় রয়েছে সাতক্ষীরা সদর (আংশিক), দেবহাটা, কালিগঞ্জ এবং শ্যামনগর (আংশিক) ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় তালা, কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর (আংশিক), আশাশুনি ও শ্যামনগর (আংশিক) উপজেলায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ’৬০-এর দশকে নির্মিত ওয়াপদার এ বাঁধ এখন উপকূলের মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। এসব বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৫৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে। প্রলয়ংকরি ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রায় চার মাস অতিবাহিত হলেও সাতক্ষীরার আশাশুনি  উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের শ্রীপুর, কুড়িকাহুনিয়া, কল্যাণপুর, নাকনা, সনাতনকাটি, প্রতাপনগর পশ্চিম ও  পূর্ব প্রতাপনগর এলাকার ২৫ হাজার মানুষ এখনো লোনা পানির জোয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছে। কপোতাক্ষ নদ এবং খোলপেটুয়া নদীর নোনা পানি প্রতানগরের বন্যতলা এবং কুড়িকাউনিয়া বাঁধ দিয়ে প্রবশ করে পুরো এলাকায় জোয়ার-ভাটা চলছে। ইউনিয়নের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ির আঙিনা পানিতে ডুবে আছে। চরম দুর্ভোগ নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। এসব বানভাসি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে বাড়ি থেকে বের হন বাঁশ ও কাঠের ভেলা অথবা নৌকায়। ইউপি চেয়ারম্যান সরদার জাকির হোসেনের দাবি, ৪০ ভাগ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অবস্থান নিয়েছেন অন্যত্র। আর ২০ ভাগ মানুষ বসবাস করছেন জেগে থাকা বেড়িবাঁধের ওপর টংঘর বেঁধে। আর বাকিরা নদীর জোয়ার-ভাটার পানির মধ্যে বসবাস করছেন চরম দুর্ভোগে। প্রতাপনগর ইউনিয়নের কল্যাণপুর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৮২ বছরের বৃদ্ধ আজিবর গাজী বলেন, প্রতাপনগরের এত ভয়াবহ খারাপ অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। এলাকায় কেউ অসুস্থ হলে নৌকা করে অনেক কষ্টে নিয়ে যেতে হয় উপজেলা হাসপাতালে। মৃত্যু হলে মাটি দেওয়ার মতো কোনো উঁচু জায়গা নেই। সব পানিতে তলিয়ে আছে। চারদিকে পানি আর পানি। নোনা পানির কারণে ফসল ফলে না। তাই কর্মহীন মানুষ। কাজ নেই, খাদ্য ও খাবার পানি সংকট। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকে এখনো বাড়ি ফিরতে পারেনি। আমরা ত্রাণ চাই না, আমাদের একটাই দাবি, টেকসই বেড়িবাঁধ। আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসিম বরণ চক্রবর্তী জানান, সাতক্ষীরার উপকূলে প্রায় ২৫ শতাংশ স্থানে বেড়িবাঁধের চিহ্ন বিলীন হয়েছে। ৫০ ভাগ বেড়িবাঁধ কম-বেশি বিধ্বস্ত ও জরাজীর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণির অসৎ প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী-ঠিকাদার মিলে সংঘবদ্ধ চক্র বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে নয়-ছয় করেই সারা বছর করেন সংস্কারের কাজ। পাউবো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নামমাত্র কাজ করেই মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করেন ঠিকাদাররা। ফলে ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ উপকূলবাসীর মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেড়িবাঁধ সংস্কার, জোড়াতালি, মেরামত কাজের মান নিয়ে উপযুক্ত তদারকি, যাচাই, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। ফলে মানসম্মত কাজ না হওয়ায় বেড়িবাঁধ টিকছে না। এসব দায়সারা গোছের কাজের কারণে বিপন্ন উপকূলবাসীর জীবন জীবিকা। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, আম্ফানের আঘাতে সাতক্ষীরায় ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ৮৩ হাজার ৪৩১টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্থ হয় ও ৮১ কিলোমিটার রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া সাড়ে ৫৬ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা মৎস্য খাতে ও কৃষিতে মোট ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং প্রাণিসম্পদে ৯৫ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতি হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ল-ভ-  হয়ে যায় উপকূলীয় অঞ্চল। হাজার হাজার বিঘা খেতের ফসল নষ্ট হয়। ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, গাছপালা ইত্যাদি ক্ষতির পাশাপাশি ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে।

একই বছরের ১২ মে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ফণী। দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে আবারও রিং বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়।

সর্বশেষ খবর