রবিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

মোগলহাট শুল্কবন্দর চালু হলে খুলবে অর্থনীতির আরেক দরজা

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

মোগলহাট শুল্কবন্দর চালু হলে খুলবে অর্থনীতির আরেক দরজা

বন্ধ অথচ সম্ভাবনাময় মোগলহাট শুল্কবন্দরটি চালু হলে খুলে যেতে পারে লালমনিরহাটের অর্থনীতির দ্বার। এই শুল্কবন্দরটি চালু হলে একদিকে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। অন্যদিকে এই বন্দরে কর্মসংস্থান হবে জেলার অন্তত কয়েক শ দরিদ্র মানুষের। তাই লালমনিরহাটের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সদর উপজেলার মোগলহাট শুল্কবন্দরটি চালু এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। জেলার সদর উপজেলার মোগলহাট শুল্ক ও স্থলবন্দর চালু হলে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটানের সঙ্গে ত্রিদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানিতে প্রসার, যোগাযোগ, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পুঁজি বিনিয়োগ এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি এ অঞ্চলে অর্থনীতির উন্নয়নে সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে বলে মনে করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সচেতন মহল। লালমনিরহাটের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই বন্দরটি চালু হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগের মাধ্যমে ত্রিদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। তেমনি অবহেলিত লালমনিরহাটের অর্থনীতির চিত্রও পাল্টে যাবে। তাই এই বন্দরটি চালু করা এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। একই কথা জানালেন জেলার উন্নয়নকর্মী ফেরদৌসী বেগম বিউটি। তিনি বলেন, দারিদ্র্যপীড়িত জেলা লালমনিরহাটের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হলে অবশ্যই কালপরম্পরায় না করে মোগলহাট বন্দরটি চালু করা প্রয়োজন। সরেজমিন জানা যায়, জেলা শহরের মাত্র ৮ কিলোমিটার উত্তরে মোগলহাট ইউনিয়ন। এখানে রেল স্টেশন, পাকা সড়ক, বিজিবি চেকপোস্ট, আবগারি শুল্ক দফতরসহ প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র আছে। মোগলহাট থেকে মাত্র হাফ কিলোমিটার উত্তরে ভারতের গিতালদহ ইউনিয়ন, যেখানে ধরলা নদীর ওপর তিস্তা রেলসেতুর ন্যায় অপর একটি সেতু আছে। যেটির নাম গিতালদহ সেতু। জানা গেছে, এক সময় গিতালদহ রেলসেতু দিয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কোচবিহার, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আসামের গৌহাটি, দার্জিলিং জেলাসহ অরুণাচল, হিমাচল, মেঘালয় থেকে কাঠ, কয়লা, পাথর, চুন, সার ইত্যাদি আসত বাংলাদেশে। কিন্তু ১৯৮৮ সালের প্রবল বন্যায় ধরলা নদীর তীব্র স্রোত ও ভাঙনে ভারত ও বাংলাদেশ অংশের প্রায় ২ কিলোমিটার রেলপথ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লালমনিরহাট থেকে মোগলহাট পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে উভয় দেশের শুধু পাসপোর্ট ধারীরা যাতায়াতের জন্য দীর্ঘদিন এ রুট ব্যবহার করে আসছিল কিন্তু ২০০২ সালের জুলাই থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯৬ সালে লালমনিরহাটে এক নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোগলহাট রেলওয়ে স্টেশন, চেকপোস্ট ও ইমিগ্রেশন চালুসহ শুল্ক স্টেশন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে মোগলহাটকে রেলরুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অপরদিকে ২০১১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মোগলহাটে শুল্ক স্টেশন স্থাপনে অবকাঠামো, নিরাপত্তা, বাণিজ্য সম্ভাবনা, লোকবল ও যোগাযোগ বিষয়ে পর্যালোচনা পূর্বক মতামত প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু দীর্ঘ ১০ বছর অতিক্রম হলেও বন্দরটি আজও চালু হয়নি বাংলাদেশ রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাট থেকে মোগলহাট পর্যন্ত বিদ্যমান রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে মোগলহাট শুল্ক ও স্থলবন্দর চালু করলে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে। তবে এ জন্য মোগলহাট রেলগেট সংলগ্ন রেলের জায়গাগুলো উদ্ধার করে রেলপথ প্রশস্ত এবং চালু করতে হবে। লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সূত্রে জানা যায়, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর উদ্যোগে ২০১৬ সালের ১৫ থেকে ১৭ জুলাই ভারতের কলকাতার শিলিগুড়িতে চার দেশীয় বিজনেস ডেলিগেশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের ব্যবসায়ী নেতারা অংশগ্রহণ করেন। এ সময় লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের এক দ্বিপক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ভারতের পশ্চিম বঙ্গের উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্র ঘোষ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধি দলের নেতারা মোগলহাট চেকপোস্ট ও স্থলবন্দর চালু করণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। মন্ত্রিসভায় অবহিত করেন যে, ভারতের পক্ষ থেকে ধরলা নদী শাসন ও রাস্তা নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সর্বপরি ভারত সরকার মোগলহাটের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। এই যোগাযোগের পথটি চালু করার জন্য পশ্চিম বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মানুষজন আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন।

মোগলহাট স্থলবন্দর বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির আহ্‌বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন জানান, মোগলহাট স্থলবন্দরটি পুনরায় চালু হলে জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠাসহ বেকারত্ব অনেকটা কমে আসবে। শুধু তাই নয়, পাল্টে যেতে পারে সীমান্তবর্তী মোগলহাট শুল্ক স্থলবন্দরের চিত্র। মোগলহাট স্থলবন্দরে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক বিষয়ের উন্নতি ঘটবে, বাড়বে সরকারি রাজস্ব। লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সিরাজুল হক জানান, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মোগলহাট স্থলবন্দরটি চালু এ অঞ্চলের মানুষের গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই আবারও এটি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এ জেলার মানুষ বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এগিয়ে যাবে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানালেন, মোগলহাট শুল্কবন্দরটি চালুর কাজ চলছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করে ফাইল অগ্রগতি করেছে। আশা করছি খুব শিগগিরই এটি আলোর মুখ দেখবে।

সর্বশেষ খবর