শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকিতে উপকূল

মনিরুল ইসলাম মনি, সাতক্ষীরা

জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকিতে উপকূল

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে হুমকিতে পড়েছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। এমনকি খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্রও বাদ যায়নি। প্রতিবছর ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙন, জোয়ারভাটা, জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির সংকট লেগেই আছে। ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলের জনপদ সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়ন এবং আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের মানুষ। জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে কোনো রকমে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ ভিটায় টিকে আছে অনেক উপকূলবাসী। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর থেকে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে এখনো ভাসছে প্রতাপনগর ইউনিয়ন। ২২টি গ্রামের মধ্যে ১৮টি গ্রাম পানিবন্দি। ফলে এখানকার মানবসম্পদ ও অর্থনীতি চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। নদীর বন্যতলা বাঁধটি পর্যন্ত সংস্কার না হওয়ায় টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ডুবে থাকায় নিঃস্ব হয়েছেন এলাকার ঘের ব্যবসায়ীরা। আশাশুনির সঙ্গে প্রতাপনগরের সরাসরি যাতায়াতের রাস্তাটি এখনো পুরোপুরি সংস্কার হয়নি। উপকূলবাসীকে চলাচল করতে হচ্ছে বাঁশের সাঁকো, কাঠের ভেলা ও নৌকায়। নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে হাজার হাজার উপকূলবাসী বাপ-দাদার ভিটামাটি ছেড়ে চলে গেছে অন্য স্থানে। অনেকে কোনো রকমে স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে উঁচু স্থানে বেড়িবাঁধের ওপরে খুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করছে। তাদের দাবি ত্রাণ নয় চাই বেঁচে থাকার জন্য  টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। তবে দুর্ভোগ লাঘবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় গ্রামবাসীর অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে।  সরেজমিন দেখা গেছে, চারদিকে পানি আর পানি। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর দীর্ঘ দেড় বছরেও এই এলাকার রাস্তাঘাট পুরোপুরি সংস্কার হয়নি। আশাশুনি সদর থেকে মানিকখালি ব্রিজ হয়ে মাদিয়া বিলের মধ্য দিয়ে সরাসরি প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন প্রধান সড়কটির ভেঙে যাওয়া গড়িমহল খাল এলাকায় রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। বরাদ্দ না থাকায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নিজ অর্থায়নে পানির মধ্যে বালির বস্তা দিয়ে ও ইট-বালি ফেলে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। চারদিকে পানি থাকায় মাদিয়া বিলের গড়িমহল খাল দিয়ে নৌকায় এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। প্রতিদিন দুইবার খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারভাটার নোনা পানি বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ওঠানামা করছে। জোয়ারের কোমর সমান পানির কারণে বাঁশের সাঁকো, কাঠের ভেলা আর নৌকায় যাতায়াত করছে এলাকাবাসী। জমিতে ফসল ফলে না। কাজ না থাকায় এলাকায় বেকারত্ব বাড়ছে। জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গাছ-গাছালি মারা যাচ্ছে। রয়েছে খাবার পানির সংকট। সব মিলিয়ে লবণ পানির আগ্রাসনে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। চারদিকে এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ২০০৯ সালে প্রথম ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আইলাসহ ঘূর্ণিঝড় সিডর, মহাশেন, আম্ফান ও সর্বশেষ ইয়াসের প্রভাবে ল-ভ- হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ। গত কয়েক দশক ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল নিমজ্জিত ও লবণাক্ত পানি বৃদ্ধিসহ প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে এ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

 প্রতাপনগরের জাফর আলী গাজী জানান, ইয়াসের সময় নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। ভিটাবাড়িসহ জমি, মাছের ঘের সব নদীতে চলে গেছে। আমার তিন বিঘা জমি এখন নদীতে। খুব করুণ অবস্থায় রয়েছি। চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখানে আমার মতো ২০টা পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে চলে গেছে নদীতে। কেউ বাঁধের ওপর বসবাস করছে আর কেউ কেউ চলে গেছে অন্যত্র। এদিকে গত ২৬ মে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইয়াসের প্রভাবে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের বন্যতলা খোলপেটুয়া নদীর ৮০ মিটার ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধটি এখনো সংস্কার করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে বন্যতলা এলাকার বাঁধটি সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পে বাঁধ মেরামত কাজটি বাস্তবায়ন করছেন ফেনী জেলার সালেহ আহম্মেদ নামের একজন ঠিকাদার। কিন্তু কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। ধীরগতিতে কাজ হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। সেখান দিয়ে  জোয়ারের পানি প্রবেশ করে প্রতাপনগরসহ পার্শ্ববর্তী শ্রীউলা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে আছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, চলতি বছরের ২৬ মে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইয়াসের সময় আশাশুনির খোলপেটুয়া নদীর বন্যতলা এলাকায় ৮০ মিটার  বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার কাজ। অগ্রগতির বিষয়টি তারা বলতে পারবেন। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে খুলনা-সাতক্ষীরা মিলে ৪২৬ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ রয়েছে। এ ছাড়া ১ ও ২ এর অধীনে জেলায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬৮০ কিলোমিটার। সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অচিরেই কাজ শুরু হবে। উপকূলের টেকসই বেঁড়িবাধ নির্মাণের ৪৭৫ কোটি টাকা অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী খনন, ৮৮টি খাল খনন, স্লুইস গেট রিপিয়ারসহ আর বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের কাজ রয়েছে।

সর্বশেষ খবর