শনিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সুদের ফাঁদে নিঃস্ব

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

সুদের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সাধারণ মানুষ। মহাজনের সুদের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় নানাভাবে হয়রানি এমনকি মামলার কবলে পড়ে অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে বসতভিটা-জায়গা জমি বিক্রি করেও আসলের সুদ এবং সুদের সুদ পরিশোধ করতে না পেরে মানসিক ও আর্থিক যন্ত্রণায় ভুগছে। সিরাজগঞ্জ জেলায় বেশ কিছু মহাজন সুদে টাকা লাগিয়ে ঘরে বসে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করছে। তেমনি একজন সুদের বড় মহাজন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাগুড়াবিনোদ ইউনিয়নের ঘরগ্রাম পূর্বপাড়া এলাকার হেলাল হোসেন। কতিপয় সহযোগী নিয়ে গড়ে তুলেছেন সুদ ব্যবসার কারবার। তার সুদের ফাঁদে পড়ে শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। সমবায় অধিদফতরের কোনো অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষের কাছ থেকে ব্যাংকের ফাঁকা চেকের পাতায় স্বাক্ষর রেখে চড়া সুদে লাখ লাখ টাকা দিচ্ছেন। আসলেরও কয়েক গুণ  বেশি সুদ আদায় করছেন। সুদেরও সুদ নেন তিনি। হেলালের সুদের জালে একবার আটকা পড়লে বের হওয়া কঠিন। সুদ-আসল কোনোটাই তার পরিশোধ হয় না। সময়মতো কেউ সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে আবার সুদ পরিশোধ করলেও ফাঁকা ব্যাংক চেকে তিনি ইচ্ছামতো টাকা বসিয়ে কোর্টে মামলা করেন।

এভাবে অন্তত শতাধিক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। মামলার ভয়ে এসব পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের চকরসুল্লা গ্রামের মাসুদ রানা জানান, পারিবারিক প্রয়োজনে এক বছর আগে হেলালের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চড়া সুদে লোন নেন। টাকা নেওয়ার সময় তার কাছ থেকে চারটি ফাঁকা চেক নেয় হেলাল। প্রথম কয়েক মাস ঠিকভাবে সুদ পরিশোধ করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে কয়েক মাস সুদ দিতে না পারায় আমার দেওয়া সাদা চেকে ইচ্ছামতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে হেলাল ও তার ম্যানেজার ফারুক আহম্মেদ রনিকে দিয়ে কোর্টে চারটি মামলা করেছে। মামলায় ১ কোটি ৯০ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকার পাওনা দেখানো হয়েছে। এরপর মামলা থেকে বাঁচতে বাড়ির জায়গা, মহিষলুটি বাজারের একটি মৎস্য আড়ত তার নামে লিখে দেওয়া হয় এবং স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে মোট ২০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। তারপরও সে মামলা উত্তোলন না করে উল্টো পুলিশ দিয়ে আমাকে হয়রানি করছে। তার ভয়ে আমি স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এভাবে মানসিক অত্যাচার করতে থাকলে আমার আত্মহত্যা ছাড়া বিকল্প পথ নেই।  তাড়াশ উপজেলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আবদুল মোত্তালিব জানান, দেড় বছর আগে পারিবারিক প্রয়োজনে শতকরা ৬ টাকা হারে হেলালের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা সুদে গ্রহণ করা হয়। ওই সময় সে দুটি স্বাক্ষরযুক্ত ফাঁকা চেক গ্রহণ করে। যথারীতি সুদসহ আসল টাকা ফেরত দেওয়া হয়। বিনিময়ে আমার দুটি চেক ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও একটি চেক খুঁজে পাচ্ছে না বলে তার কাছে রেখে দেয়। কিছুদিন পর আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয় আপনার বিরুদ্ধে ৩০ লাখ টাকার চেক ডিজঅনার মামলা হয়েছে। আমি শুনে হতভম্ব হয়ে পড়ি। পরে এলাকার লোকজন মারফতে আরও কয়েক লক্ষাধিক টাকা গচ্ছা দিয়ে তার মামলা থেকে রক্ষা পাই। ভায়াট গ্রামের এনামুল হোসেন জানান, আমি দেড় লাখ টাকা চড়া সুদে নেওয়ার পর কয়েক বছর পর জমি বিক্রি করে সুদে আসলে ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করি। কিন্তু তার কাছে দেওয়া একটি চেক ফেরত দেয় এবং আরেকটি পরে দেব বলে রেখে দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারি ওই চেক দিয়ে আদালতে আমার বিরুদ্ধে ৫ লাখ টাকার মামলা দায়ের করেছে।  কলেজ প্রভাষক আবুল বাশার জানান, জরুরি প্রয়োজনে হেলালের কাছ  থেকে ৫ লাখ টাকা সুদে গ্রহণ করি। আমার স্বাক্ষরযুক্ত দুটি সাদা চেক জমা দিয়ে ওই টাকা নিই। সুদসহ টাকা পরিশোধের পর একটি চেক ডিজঅনার করে আমার বিরুদ্ধে তার ম্যানেজার ফারুক আহম্মেদ রনিকে দিয়ে ৪০ লাখ টাকার মামলা করেছে। মামলা নিয়ে আমি চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছি। নওগাঁ বাজারের মিজানুর রহমান জানান, ৫-৬ বছর আগে দুটি সাদা চেক জমা দিয়ে ১০ লাখ টাকা হেলালের কাছ থেকে সুদে গ্রহণ করি। পরবর্তীতে সুদে আসলে টাকা পরিশোধ করি। তখন সে একটি চেক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তার কাছে রেখে দেয়। কিছুদিন পর সে ওই চেক দিয়ে তার এক কর্মচারী আবদুস সালামকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ৯০ লাখ টাকার মামলার দায়ের করেছে। বর্তমানে মামলার জালে পড়ে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন যাপন করছি। শুধু আবদুস সালাম বা প্রভাষক আবুল বাশার নয়, এমন ভুক্তভোগী পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার সমাজ গ্রামের আবুল হাশেম, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের সাকুয়াদিঘী গ্রামের রফিকুল ইসলাম রফিকসহ পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার শতাধিক মানুষ। ভুক্তভোগী এসব অসহায় মানুষ মামলার জালে ফেঁসে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ভুক্তভোগীরা সুদারু হেলালের প্রতারণা থেকে বাঁচতে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্তপূর্বক মামলার হাত থেকে বাঁচানোর দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সুদে টাকা দেওয়া আমার ব্যবসা। কেউ টাকা না দিলে মামলা করব এটাই স্বাভাবিক।  এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মদ জানান, সুদ কারবারি হেলালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ সুপারকে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য সুদ ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর